বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১
হাসান মাহমুদ রিপন
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:১৬ এএম
আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

তাপস-ঘনিষ্ঠ শাহজাহানের রাজা-বাদশাহর জীবন

মাসে যা বেতন পান ব্যয় করেন তার দ্বিগুণ
তাপস-ঘনিষ্ঠ শাহজাহানের রাজা-বাদশাহর জীবন

যা বেতন পান, প্রতি মাসে ব্যয় করেন তার দ্বিগুণেরও বেশি টাকা। মাসে বেতন লাখ টাকার কম হলেও চলাচল সামন্ত আমলের রাজা-বাদশাহর মতো। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বানিয়েছেন কোটি টাকার সম্পত্তি। আলোচিত এই ব্যক্তির নাম মো. শাহজাহান আলী; ডিএসসিসির উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা। শাহজাহান আলীর অপরাধের এখানেই শেষ নয়, ডিএসসিসির নারী কর্মচারীর সঙ্গে জড়িয়েছেন অনৈতিক সম্পর্কে। ভ্রূণ হত্যার বিচার চাওয়ায় সেই নারী কর্মচারীকে করেছেন চাকরিচ্যুত।

নথি পর্যালোচনা ও তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে ডিএসসিসিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানাভাবে ফায়দা নিয়েছেন শাহজাহান আলী। তাকে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর কর পরীবিক্ষণ শাখায় উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার (চ. দা.) দায়িত্ব দেওয়া হয়। অথচ ২০২২ সাল থেকেই তিনি এই পদবি ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে আর্থিকসহ নানা অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন। নিজের ইচ্ছামতো কর নির্ধারণ করতেন। তথ্য বলছে, প্রতি মাসে শাহজাহান আলী যা বেতন পান, তার থেকে ব্যাংকের কিস্তি জমা দেন বেশি। এ ছাড়া বাড়ির কেয়ারটেকার এবং গাড়িচালকদের বেতন ও মেইনটেইন্যান্স খরচ তো আছেই। অথচ শাহজাহান আলী প্রতি মাসে বেতন পান সর্বসাকল্যে ৯৫ হাজার ৯৩৫ টাকা। সম্প্রতি শাহজাহান আলী তার বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রী সাবিয়া সুলতানা মলিকে মূল্যবান হীরার নেকলেস ও আংটি উপহার দেন। আর গত ৯ সেপ্টেম্বর আর্মি গলফ ক্লাবে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে খরচ করেছেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

রাজধানীর উত্তরা এলাকার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৯ নম্বর রোডের ৯৭ নম্বরে ৩ কাঠার প্লটটি ২০০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর শাহজাহান আলী ও তার স্ত্রীর নামে দলিল রেজিস্ট্রি হয়। দলিলে রেজিস্ট্রি খরচ কমাতে ও আইনি ঝামেলা এড়াতে ৩ কাঠা জমির মূল্য মাত্র ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা দেখানো হয়। তবে সেখানে স্থানীয়ভাবে প্রতি কাঠা জমির দাম প্রায় কোটি টাকা। এই জমিতে নির্মাণ করেন ৭ তলা বাড়ি। এর মধ্যে তৃতীয় এবং চতুর্থ তলা ডুপ্লেক্স। তথ্য বলছে, বৃহৎ এই বাড়িটির জন্য শাহজাহান আলী বছরে হোল্ডিং ট্যাক্স দেন মাত্র ৩৩ হাজার টাকা। বিলাসবহুল এই বাড়িটি ছাড়াও শাহজাহান আলীর রয়েছে দুটি দামি ব্যক্তিগত গাড়ি।

অভিযোগ রয়েছে, উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদবি দেখে অনেকে তার কাছে অবৈধ কর সুবিধা নিতেন। তদবির করতেন বিভিন্ন কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানের মালিক বা প্রতিনিধিরা। এভাবেই তিনি বাটা সু কোম্পানিতে প্রশাসন শাখায় নিজের মেয়েকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। তা ছাড়া শাহ সিমেন্ট কোম্পানিকে অনেকদিন আগে কর প্রদানের চিঠি দিলেও কোম্পানিটির কর ফাইল এখনো খোলা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, মো. শাহজাহান আলী ডিএসসিসির অঞ্চল-২-এ কর কর্মকর্তা থাকাকালে রাজস্ব বিভাগের মাস্টার রোলে (দক্ষ) কাজ করা এক সহকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে ওই নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তিনি বিয়ের জন্য শাহজাহান আলীকে চাপ দিতে থাকেন। শাহজাহান আলী বিয়েতে অস্বীকৃতি জানালে ওই নারী ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ শাহজাহান আলীকে বরখাস্ত করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান অঞ্চল-২ এর তৎকালীন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু নঈম তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ৬ মে মো. শাহজাহান আলীকে দোষী সাব্যস্ত করে অভিযোগনামা দাখিল করেন। এরপর শাহজাহান আলী মেয়র তাপসের এক দেহরক্ষীসহ বিভিন্ন লোকজন দিয়ে ওই নারীকে নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দেন। একপর্যায়ে গর্ভে থাকা ভ্রূণ নষ্ট করে ওই নারী নিজের দোষ স্বীকার করে ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর তিনশ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে আপসনামায় স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হন। এরপর ২০১৮ সালের ১১ জুলাই আবারও তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএসসিসি। নতুন তদন্তে শাহজাহান আলীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। মেয়র তাপসের প্রভাব খাটিয়ে উল্টো ওই নারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শাহজাহান আলী বলেন, ‘আমি নিজে কিংবা কাউকে দিয়ে ওই নারীকে ভয়ভীতি দেখাইনি। তিনি স্বেচ্ছায় আমার বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগ তুলে নিয়েছেন। আমি ওই নারীকে চাকরিচ্যুত করাইনি বা তার চাকরিচ্যুতির পেছনে আমার কোনো ইন্ধনও ছিল না। তার চাকরি পুনর্বহাল হোক, তা আমিও চাই।’

তবে ভুক্তভোগী ওই নারীর জবানবন্দি দেওয়া একটি অডিও রয়েছে এ প্রতিবেদকের কাছে। এতে ওই নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘শাহজাহান আলীর কারণে আমার চাকরি গেছে, মানসম্মানও গেছে। তার জীবনে আমি প্রথম নই, শেষও নই। তিনি অতীতেও এমন ঘটনা অনেক ঘটিয়েছেন বলে শুনেছি।’

এদিকে, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সাবেক মেয়র তাপসের সঙ্গে যোগসাজশ করে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন শাহজাহান আলী। তাপস আদালতের আদেশের তোয়াক্কা না করে তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রথমে রাজস্ব কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দেন। তবে পদোন্নতি হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত করা হয়। উচ্চ আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে ডিএসসিসি আপিল করে। আপিল আদালতও হাইকোর্টের স্থগিতের আদেশ বহাল রাখেন। এরপর ডিএসসিসি সুপিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করলে সেখানেও আগের আদালতের স্থগিত আদেশ বহাল রাখা হয়। তবে আদালতের এসব আদেশ উপেক্ষা করে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ মো. শাহজাহান আলীকে দুই দফা পদোন্নতি দেয়। বিষয়টি বেআইনি এবং আদালত অবমাননার শামিল উল্লেখ করে ঢাকা জেলা জজ আদালতের আইনজীবী সাইফুল আজম টিটু বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা আদেশের পর পদোন্নতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

শাহজাহান আলীর দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. সাইদুজ্জামান ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর ও ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর দুটি নোটিশ দেন। নোটিশে তার কর্মকালীন খিলগাঁও-বাসাবো-তিলপাপাড়া এবং কলাবাগান ও ধানমন্ডি এলাকার বিভিন্ন বাড়ি, প্রতিষ্ঠান এবং মার্কেটের দোকানের কর নির্ধারণ-সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের ছায়ালিপি চাওয়া হয়। পরে অদৃশ্য কারণে বিষয়টি সেখানেই থমকে যায়। শাহজাহান আলীর দুর্নীতির বিষয়টিও ধামাচাপা পড়ে যায়।

অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাহজাহান আলী। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘বাড়ি নির্মাণে অগ্রণী ও ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি। এখনো তার কিস্তি শোধ করছি।’ দুই ব্যাংক থেকে একই বাড়ির ওপর ঋণ নিলেন কীভাবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইনসিদ্ধ না হলেও অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ আড়াল করে পরে ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে ঋণ নিই।’ দুটি গাড়ি থাকার বিষয়টিও অস্বীকার করেন শাহজাহান আলী।

শাহজাহান আলীর দুর্নীতির বিষয়ে ডিএসসিসির সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঞা কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এ দপ্তরে সদ্য দায়িত্ব পেয়েছি। যার ফলে আমি আগের অনেক কিছুই জানি না। তবে সংস্থার কেউ বেআইনি কিছু করলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘অন্য কোনো আয়ের মাধ্যম ছাড়া বেতনের চেয়ে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী ব্যয় বেশি করলে স্বাভাবিকভাবেই সেটা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তদন্ত সাপেক্ষে এসব ব্যাপারে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিনা খরচে বিয়ে-হানিমুনের সুযোগ, যা করতে হবে

ডাকসুর রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি

'রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আ.লীগের প্রেতাত্মারা এখনো বহাল'

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শুরু, যা জানা যাচ্ছে

অ্যাম্বুলেন্স রেখে ছেলের গাড়িতে চড়ে হাসপাতালে গেলেন খালেদা জিয়া

লিফলেটে শেখ হাসিনার বাণী, ৩ কর্মকর্তার শাস্তি

ভিন্ন নারীকে মেজর ডালিমের স্ত্রী দাবি

বরিশালে বিএনপির দুই নেতার বাড়িতে হামলা

বিজিবির আপত্তিতে শূন্যরেখা থেকে স্থাপনা সরিয়ে নিল বিএসএফ

অছাত্রদের দিয়ে জাবি ছাত্রদলের কমিটি

১০

কিশোরীর শ্লীলতাহানি, ৩ লাখ টাকায় ধামাচাপার চেষ্টা

১১

ঢাবির আবাসন সুবিধা পেতে আগ্রহী ছাত্রীদের আবেদনের আহ্বান

১২

হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে দেওয়া চিঠির জবাব এখনো আসেনি : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৩

অবৈধভাবে পদ্মায় বালু উত্তোলনের দায়ে ৯ জনের কারাদণ্ড

১৪

ছাত্রলীগের পদ নেওয়াকে কৌশল বললেন ছাত্রদল নেতা

১৫

সার না দেওয়ায় কৃষি কর্মকর্তা অবরুদ্ধ

১৬

ইউসিটিসিতে সিন্ডিকেট মিটিং অনুষ্ঠিত

১৭

রাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাল্টা প্রতিক্রিয়া হাসনাত আব্দুল্লাহর

১৮

প্যাট্রিক কেনেডির অধীনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শুরু 

১৯

গোপনে স্বামীর ফোনে নজরদারি করে বিপাকে স্ত্রী

২০
X