দেড় বছরের আগে দেশীয় খনির জ্বালানি তেল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। সিলেটের তামাবিলে আবিষ্কৃত কূপ খননের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদনে গতকাল জ্বালানি বিভাগ থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে পরিকল্পনা কমিশন থেকে সপ্তাহখানেকের মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
জানা গেছে, চলতি মাসের শেষে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য একনেকের সভায় উত্থাপন করা হবে। একনেকের অনুমোদন পাওয়ার পর কূপ খননে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। দরপত্রের কার্যক্রম শেষ করতে সময় লাগবে আট মাস। দরপত্রে যে কোম্পানি কাজ পাবে, ওই কোম্পানিকে রিগসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য যন্ত্রপাতি এনে খনন কাজ শুরু করতে সময় প্রয়োজন হবে আরও ৫ মাস। খনন শুরুর পর তেল উত্তোলন ও সরবরাহ করতে আরও ৫ মাস সময় লেগে যাবে। সব ঠিক থাকলে দেড় বছর পর অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনের পর দেশীয় কূপ থেকে জ্বালানি তেল পাওয়া যাবে। জ্বালানি
বিভাগ ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের (এসজিএফএল) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তামাবিলে অবস্থিত সিলেট-১০ নম্বর কূপে তেলের মজুত নির্ণয়ে কাজ করছে মার্কিন কোম্পানি স্লামবার্জার। গত আগস্টে মজুত সম্পর্কে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মজুত প্রতিবেদন জমা পড়ে অক্টোবরের শুরুতে।
প্রতিবেদনে শুধু তেল উত্তোলনে সিলেট-১০ নম্বর কূপের পাশে সিলেট-১২ নামে আরেকটি কূপ খননের পরামর্শ দেওয়া হয়। ১০ নম্বর কূপ থেকে চার কিরোমিটার দূরে ধুপিঢোলায় সিলেট-১২ কূপের অবস্থান। এ ছাড়া প্রাথমিক মজুত দেখানো হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৪৮ লাখ ব্যারেল। মজুতের ৭০ শতাংশ তেল উত্তোলনযোগ্য। ধারণা করা হচ্ছে, কূপটি থেকে দৈনিক ৬০০ ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন করা যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেট-১২তে একটি কূপ খনন করার পর বোঝা যাবে মজুত বাড়বে কি না। সম্ভাবনা বেশি বলে ধারণা এসজিএফএলের কর্মকর্তাদের।
এসজিএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) প্রকৌশলী রেজাউল ইসলাম এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, সিলেট-১২-এর ডিপিপি আজ (গতকাল) জ্বালানি বিভাগ থেকে পরিকল্পনা কমিশনে গিয়েছে। আশা করছি, এই মাসে একনেকের অনুমোদন হয়ে যাবে। এরপর উন্মুক্ত দরপত্রে যাব। সব প্রক্রিয়া শেষে এই কূপ থেকে তেল পেতে দেড় বছর লাগবে।
মজুত বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ১৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ব্যারেল মজুতের ধারণা আমরা পেয়েছি। মজুত আরও বাড়তে পারে। এখন যে মজুত আছে তাতে দিনে ৬০০ ব্যারেল তেল উত্তোলন সম্ভব।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তামাবিলে আবিষ্কৃত তেলের কূপ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ বিধানের অধীনে চীনের কোম্পানি সিনোপ্যাককে দিয়ে করানোর পরিকল্পনা ছিল। পটপরিবর্তনের পর বিশেষ আইনে নেওয়া প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। পরে অন্তর্বর্তী সরকার কূপ খননের কাজ উন্মুক্ত দরপত্রে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ১০ ডিসেম্বর সিলেট-১০ কূপের একটি স্তরে তেল পাওয়ার ঘোষণা দেন সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। একই কূপে গ্যাসের তিনটি স্তর পাওয়া গিয়েছিল। তামাবিল অঞ্চলে ৮ দশমিক ৪৮ একর এক ফসলি জমিতে অনুসন্ধান কূপ খননের সময় তেলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
সিলেট-১০ নম্বর কূপ খননে ২০২১ সালের অক্টোবরে ২০২ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। খনন ঠিকাদার হিসেবে চীনা কোম্পানি সিনোপ্যাকের সঙ্গে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে টার্নকি চুক্তি সই করে কর্তৃপক্ষ। এ কূপে চারটি স্তরে গ্যাস ও একটি স্তরে তেল পাওয়া গেছে। ২ হাজার ৫৪০ থেকে ২ হাজার ৫৬৫ মিটার গভীরতায় ডিএসটি চলাকালীন দৈনিক ২২ থেকে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস প্রবাহের বিপরীতে ওয়েলহেড প্রেশার ৩ হাজার ২৫০ পিএসআইজি। এ স্তর থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ১ হাজার ৩৯৭ থেকে ১ হাজার ৪৪৫ মিটার গভীরতায় টেস্ট করে ক্রুড অয়েল পাওয়া যায়, যার এপিআই গ্রাভিটি ২৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি। স্বয়ংক্রিয় প্রেশারে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ ব্যারেল হারে তেল প্রবাহিত হয়।
গত ১৬ ডিসেম্বর এ কূপের ৯ হাজার লিটার তেল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হয়েছে। পাঠানো তেল পরীক্ষা শেষে দেশেই পরিশোধন করা যাবে বলে মতামত দেয় ইস্টার্ন রিফাইনারি।
দেশে প্রথমবারের মতো ১৯৮৬ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রথম তেলের খনি পাওয়া যায়। তখন দৈনিক ৫০০ ব্যারেল করে উত্তোলন করা হতো। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। এর ৩৭ বছর পর দেশে আবারও জ্বালানি তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। আমদানি করা অপরিশোধিত তেলের মূল্য (প্রতি লিটার ৫৬ টাকা) হিসাবে ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা।
বিপিসির তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয়। এতে বছরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়।
এর আগে গত বছর বাংলাদেশ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এক গবেষণায় উল্লেখ করেছিলেন, পরিত্যক্ত হরিপুর তেলক্ষেত্রে আরও ৩০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রয়েছে, যার বাজারমূল্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রের ৭ নম্বর কূপে ৩ হাজার ২৬০ থেকে ৩ হাজার ২৭০ মিটার গভীরে তেলের স্তর রয়েছে, যেখানে ৯০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা।
২০১২ সালে পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর কৈলাসটিলা ও হরিপুরে তেলের মজুতের সন্ধান পেয়েছিলেন। ওই সময় জানানো হয়, এ দুটি জায়গায় তেল মজুতের পরিমাণ ১৩৭ মিলিয়ন ব্যারেল হলেও উত্তোলন করা সম্ভব ৫৫ মিলিয়ন। সন্ধান পাওয়া তেলের মধ্যে ১০৯ মিলিয়ন ব্যারেল রয়েছে কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রে। বাকি ২৮ মিলিয়ন ব্যারেল রয়েছে হরিপুর গ্যাসক্ষেত্রে। এ দুটি ক্ষেত্র থেকে সব মিলে ৫৫ মিলিয়ন ব্যারেলের মতো তেল উত্তোলন করা যাবে।