পৌষের মাঝামাঝি পেরিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। কোনো কোনো অঞ্চলে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। যেখানে তাপমাত্রার হিসাবে শৈত্যপ্রবাহ নেই, সেখানেও শীতের প্রকোপ কম নয়। গতকাল বৃহস্পতিবার কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে দেশ। সাতক্ষীরা ও যশোরের কিছু কিছু এলাকা বাদে পুরো দেশে দেখা মেলেনি সূর্যের। শীতের দাপটে জবুথবু জনজীবন। খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টের শেষ নেই। হাসপাতালে বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, তাপমাত্রা আরও এক থেকে দুই ডিগ্রি পর্যন্ত কমতে পারে। এমন পরিস্থিতি আরও দুই থেকে তিন দিন চলবে। এরপর কুয়াশা কেটে শৈত্যপ্রবাহ দাপট দেখাতে পারে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, এরকম কুয়াশা আরও দুই-তিন দিন থাকবে। এই সময়ে ঠান্ডা এখনকার মতোই থাকবে। এরপর কুয়াশা কেটে গেলে রাতের তাপমাত্রা ক্রমেই কমে শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে। জানুয়ারির ৬ থেকে ৭ তারিখের পর রাতের তাপমাত্রা কমে ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসতে পারে।
তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তীব্র শীত থাকবে। এরপর তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। তখন ধীরে ধীরে শীত কমতে পারে।
নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই যে শীত বাড়তে পারে, এর ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে এক থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি এবং এক থেকে দুটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বুধবার থেকে চুয়াডাঙ্গা ও পাবনার ঈশ্বরদীতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গতকাল চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এই সময়ে ঈশ্বরদীতে সর্বনিম্ন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রির আশপাশে। ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল টেকনাফে, ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়; ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
আজ শুক্রবার অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারা দেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে। সারা দেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি ও দিনের তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি শীতের অনুভূতি থাকতে পারে। পাঁচ দিন পর দেশের উত্তরাংশে হালকা বৃষ্টি বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং এ সময়ের শেষের দিকে তাপমাত্রা কমতে পারে।
এবার গোটা ডিসেম্বর মাসে শীতের কাঁপন টের পায়নি ঢাকাবাসী। জানুয়ারির প্রথম দিনেই ঝুপ করে নেমেছে শীত। গতকাল রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, মালিবাগ, মগবাজার, রামপুরা, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শীত রীতিমতো কাবু করে ফেলেছে মানুষকে। তীব্র ঠান্ডার কাঁপুনিতে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকা চরমভাবে ব্যাহত।
বাংলামটরে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা রিকশাচালক আক্কাস মোল্লা জানান, হালকা শীতে রিকশা চালাতে আরাম হতো, কিন্তু দুই দিনের শীতে কষ্ট হচ্ছে। একই অবস্থা অন্য শ্রমজীবী মানুষেরও।
বায়তুল মোকাররমের সামনে শীতের পোশাক বিক্রি করা আমান বলেন, কাপড় তো গায়ে দিয়েই দাঁড়াই কিন্তু ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে কাপড় বিক্রি করাই তো কঠিন। চা-পানি খেয়ে কাজ করার চেষ্টা করি।
রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর এবং রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ, পাবনা, নাটোরসহ সব জেলাতেই জেঁকে বসেছে শীত। হিমেল হাওয়া ও কনকনে ঠান্ডায় বিপর্যস্ত জনজীবন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকছে ৯ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ, পাবনা, নাটোরে তাপমাত্রার পারদ নেমেছে ১০ ডিগ্রির ঘরে।
বগুড়ায় শীতের তীব্রতা বাড়ছে। দিনের বেলায় মেঘ ঢেকে রাখায় সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। পরিবহন চালকরা জানান, কুয়াশার কারণে দুই হাত পর পর দেখা যায় না এ কারণে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।
সকালে কাজের সন্ধানে বের হওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে রয়েছেন। তারা জানান, কাজ না করলে খাওয়া নেই, তাই যত শীত হোক বের হতেই হবে, তবে এখন বাতাস আর কুয়াশা থাকার কারণে কষ্ট হচ্ছে, এখনো কেউ শীতবস্ত্র নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায়নি বলে জানিয়েছেন নির্মাণ শ্রমিকসহ দিনমজুররা।
দুদিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে না দিনাজপুরে। সেইসঙ্গে হিমেল বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধিতে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন এই এলাকার মানুষ। দুদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রিরও বেশি কমেছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে হিমেল বাতাসেরও গতি। ফলে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ।
শীতের দাপট অব্যাহত রয়েছে পঞ্চগড়ে। কনকনে বাতাসে বাড়ছে শীতের অনুভূতি। মঙ্গলবার রাত থেকে ঘন কুয়াশায় ছেয়ে যায় পথঘাট। রাতভর বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে কুয়াশা। কয়েকদিন ধরে ভোর থেকে পঞ্চগড়ে ঘন কুয়াশার কারণে মহাসড়কগুলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন।
শীতজনিত রোগে মৃত্যু ৫১ জনের: শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গত দুই মাসে ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে এসব রোগে আক্রান্ত হয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৫০ হাজার ৬১০ জন। এর মধ্যে শুধু ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ আট হাজার ৫৭৬। এ ছাড়া শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ৪২ হাজার ৩৪ জন। এদিকে মৃত ৫১ জনের মধ্যে ৫০ জনই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত ছিলেন। অন্যজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এ তথ্য জানিয়েছে।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, শীতে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ঢাকা বিভাগে ১১ হাজার ২০৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের। এ ছাড়া ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার ৯৯৮ জন। ময়মনসিংহ বিভাগে শ্বাসতন্ত্রেও রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬২২ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ২৪ জনের। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৬১০ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে শ্বাসতন্ত্রেও রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৬৪ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। এ ছাড়া ৩০ হাজার ৮৭৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজশাহী বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ১ হাজার ৯৯৪ জন ও ডায়রিয়ায় ৮ হাজার ৯৫৩ জন এবং রংপুর বিভাগে শ্বাসতন্ত্র রোগে ৫ হাজার ১২৪ ও ডায়রিয়ায় ১৯ হাজার ৯৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
খুলনা বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহে ৭ হাজার ১৪৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৯ হাজার ৮৪২ জন। বরিশাল বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহে আক্রান্ত ২ হাজার ১১৫ জনের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ৭ হাজার ৮৫২ জন।
সিলেট বিভাগে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহে আক্রান্ত ৪ হাজার ৬৭৪ জনের মধ্যে মৃত্যু একজনের। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ৫ হাজার ৪৬৩ জন।
গত ১ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বরর পর্যন্ত শ্বাসতন্ত্র রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৪২ হাজার ৩৪ জন; মৃত্যু হয়েছে ৫০ জনের। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১ লাখ ৮ হাজার ৫৭৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ১ জনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তীব্র শীতে দেশের গ্রামগঞ্জে অনেকেই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্য রোগে আক্রান্তরা শীতের কারণে বেশি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। অনেকেই শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এভাবে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।