ভোলার গ্যাস সিএনজি (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) করে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় সরবরাহ করতে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন পিএলসির সঙ্গে করা চুক্তি সংশোধন করা হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ আইনে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত এই কোম্পানিটির সঙ্গে এখন ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজি করার চুক্তি রয়েছে। চুক্তি সংশোধন করে সিএনজি করতে কোম্পানিটিকে ৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। চুক্তি সংশোধনের বিষয়ে এরই মধ্যে ইন্ট্রাকোকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনে করা চুক্তির কয়েকটি বাতিল করলেও বেশিরভাগ এখনো রয়ে গেছে। ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যে সামিট, মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলেও ইন্ট্রাকোর চুক্তি বাতিল করেনি। এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রায় তিন মাস পর গত নভেম্বরে ইন্ট্রাকো আনুষ্ঠানিকভাবে ভোলার গ্যাসকে সিএনজি করে সরবরাহ শুরু করে। ওই মাসেই বিশেষ আইন রহিতকরণ অধ্যাদেশ জারি করে বর্তমান সরকার। খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ আইন রহিত অধ্যাদেশ জারি করার মধ্য দিয়ে বিগত সরকারের অবৈধ চুক্তিগুলোকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ইন্ট্রাকোর সঙ্গে করা চুক্তি সংশোধনের উদ্যোগ উদ্দেশ্যমূলক। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীদের সুরক্ষা দিচ্ছে সরকার।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, আমরা চুক্তি সংশোধনের জন্য ইন্ট্রাকোকে চিঠি দিয়েছি। চুক্তিতে বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা রয়েছে, তা সংশোধন করা হবে। তিনি বলেন, এ ছাড়া ভোলার গ্যাস সিএনজি করতে দরপত্র আহ্বান করা হবে। নথি তৈরির কাজ চলছে। নতুন বছরের শুরুতে দরপত্র আহ্বান করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ভোলার গ্যাস সিএনজি করে সরবরাহ শুরু করেছে ইন্ট্রাকো। সামিট ও এক্সিলারেট এলার্জির মতো ইন্ট্রাকোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার সুযোগ থাকলেও জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে রহস্যজনক কারণে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। যে কারণে এ বিষয়ে পেট্রোবাংলাও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কর্মকর্তারা জানান, ভোলার গ্যাস সিএনজি করার পর যে দামে বাজারে বিক্রি করছে, তা বেশি হওয়ার কারণে শিল্প-কারখানার মালিকরা এই গ্যাস নিতে আগ্রহও দেখাচ্ছে না। প্রতিযোগিতামূলক দামে চুক্তি করা গেলে উৎপাদন খাতের অনেকেই এই গ্যাস কিনতে আগ্রহী হতেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে চুক্তি সংশোধন করতে ইন্ট্রাকোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চুক্তি সংশোধন করে কোম্পানিটিকে গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে কমিয়ে ৫ মিলিয়ন ঘনফুট করা হবে। পাশাপাশি গ্যাসের দামও সংশোধন করা হবে। নতুন বছরে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজি করতে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। এই কর্মকর্তা আরও জানান, ইন্ট্রাকোকে যখন ভোলার গ্যাস সিএনজি করার কাজ দেওয়া হয়, তখন আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছিল; কিন্তু তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় প্রভাব বিস্তার করে এককভাবে কাজটি নেয় ইন্ট্রাকো।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বিষয়টি নিয়ে কালবেলাকে বলেন, আমরা বিশেষ আইন বাতিল চেয়েছি; কিন্তু সরকার অধ্যাদেশ করে আইন রহিত করল এবং আগের সরকারের অবৈধ চুক্তিগুলোকে বৈধতা দিয়েছে। তিনি বলেন, ইন্ট্রাকোর সঙ্গে চুক্তি সংশোধন উদ্দেশ্যমূলক। অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের সুবিধাভোগীদের সুরক্ষা দিচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ রহিতকরণ অধ্যাদেশ বাতিল চেয়ে আমরা আদালতে মামলা করেছি, যা চলমান রয়েছে। জনস্বার্থে বিশেষ আইনের সঙ্গে এই আইনের অধীনে হওয়া সব চুক্তি বাতিল করতে হবে।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২১ মে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে ১০ বছরের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে ইন্ট্রাকো। পরে একই বছরের ২১ ডিসেম্বর ধামরাইয়ের অবস্থিত গ্রাফিক্স টেক্সটাইল লিমিটেডের কারখানায় সিএনজি আকারে ভোলার গ্যাস সরবরাহের মধ্যদিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। ৩ হাজার পিএসআই (প্রতি বর্গ ইঞ্চি) চাপে প্রতি সিলিন্ডারে গ্যাসের পরিমাণ ছিলো ৩৫০০ ঘনমিটার। বিশেষ আইনে করার এই চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানিটি ভোলার থেকে প্রাথমিকভাবে ৫ মিলিয়ন ঘনফুট এবং পরবর্তীতে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দৈনিক সিএনজি আকারে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করবে। চুক্তি অনুযায়ী, ইন্ট্রাকো সরকার থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনেছে ১৭ টাকায়। আর বিক্রি করছে ৪৭ টাকা ৬০ পয়সায়।
সিএনজিখাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, ভোলার গ্যাস আরও কমদামে সরবরাহ করা যেত। ভোলার গ্যাসকে ১ হাজার পিএসআই থেকে বুস্টার কম্প্রেসরের মাধ্যমে ৩ হাজার পিএসআই প্রেসারে কম্প্রেস করে মোবাইল স্টোরেজের মাধ্যমে পানি এবং স্থল পথে সহজে নিয়ে আসা যায়। এতে করে একদিকে কম্প্রেসন চার্জ অর্ধেকেরও কম হবে এবং ডিকম্প্রেসন চার্জ একেবারে বাদ যাবে। দেশে শতাধিক মোবাইল স্টোরেজ বাংলাদেশে বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন থেকে বিভিন্ন গার্মেন্ট ও শিল্পে গ্যাস সরবরাহের কাজে বিদ্যমান আছে। সরকার চাইলে কয়েক শত ইন্ডাস্ট্রিকে অনুমতি দিতে পারে যারা ফিড গ্যাসের মূল্য (ঘন মিটার ১৭ টাকা) পরিশোধ করে নিজস্ব খরচে কম্প্রেস ও পরিবহন করে তাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে আসবে। এ ছাড়া প্রতিঘণ্টায় ৫০০ ঘনমিটার গ্যাস প্রক্রিয়া করার সক্ষমতার দেশীয় ‘বুস্টার কম্প্রেসর’ মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা যেখানে প্রতিঘন্টায় বিদ্যুৎ খরচ হবে মাত্র ৫০ কিলোওয়াট সুতরাং প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কম্প্রেস করতে খরচ হবে মাত্র ২ থেকে ৩ টাকা। অন্যদিকে বর্তমানে যে মোবাইল স্টোরেজগুলো বিদ্যমান সেগুলো একেকটি প্রতি বার ৩ হাজার ঘনমিটার গ্যাস বহন করতে পারে। ভোলা থেকে ঢাকা ও আশপাশে যাতায়াত করতে যদি প্রতি বার ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে পরিবহন খরচ হবে প্রতি ঘন মিটারে মাত্র ৭ থেকে ৮ টাকা; কিন্তু বিগত আওয়ামী সরকার নির্দিষ্ট ওই কোম্পানি ছাড়া আর কোনো কোম্পানির প্রস্তাব শুনতে আগ্রহী ছিল না। ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব, প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ক্রয় মূল্য ১৭ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং কম্প্রেশন চার্জ প্রতি ঘন মিটার ১০ টাকা হারে যোগ করে বিক্রয়মূল্য ৩৭ টাকা ধার্য করা হলে সরকার, ব্যবসায়ী ও গ্রাহকরা লাভবান হবে। আগ্রহী শিল্প মালিকরা এই গ্যাস পরিবহন ভাড়া পরিশোধ করে তাদের কারখানায় নিয়ে যাবে। বর্তমানে ভোলার তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট। আর বাকি গ্যাস উদ্বৃত্ত অবস্থায় রয়েছে।