কুমিল্লার এক পরিবারের ব্যাংকে অর্ধশত কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মিলেছে, যে পরিবারটি মাত্র বছর কয়েক আগেও মাছ বিক্রি করে সংসার চালাত। এর মধ্যে একজন রিয়াল পাচারকালে সৌদি আরবে ধরা পড়ে জেল খেটেছেন ৬ মাস। রাজধানীতে রয়েছে বহুতল ভবন, একাধিক প্লট, জায়গা-জমি। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে কোটি কোটি টাকার কৃষিজমি। প্রতিবেশীদের উচ্ছেদ করে ৮০ শতক জমি দখল করে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে তৈরি করেছেন বাগানবাড়ি। জমি না ছাড়তে চাওয়ায় প্রকাশ্যে চাচাতো ভাইকে হত্যা করেছেন গলা কেটে। বিপুলসংখ্যক মানুষকে নির্যাতন, সম্পদ দখল, অবৈধ ব্যবসা, হয়রানিসহ নানা অপরাধ করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে তারা। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে গ্রামের বাইরে রাজধানীতেও ছড়িয়েছেন তাদের দখল সাম্রাজ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লার তিতাস উপজেলার সাতানি ইউনিয়নের বারকাউনিয়া গ্রামের তিন ভাই মো. রিপন মিয়া, মো. আলাউদ্দিন ও মো. লিটন মিয়া স্থানীয় কাঁঠালিয়া উপনদীতে কয়েক বছর আগেও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মেজো ভাই মো. রিপন মিয়া সৌদি আরব গেলে ভাগ্য খোলে। পরিবারটি জড়িয়ে পড়ে হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায়।
তিন ভাই ও তাদের পরিবারের একাধিক সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অন্তত ৪৮ কোটি ৩২ লাখ টাকার লেনদেনের তথ্য রয়েছে কালবেলার হাতে। ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে অন্তত ৪ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট। এসব টাকা বৈধভাবে রেমিট্যান্স হয়ে দেশে এলে কোনো কথা ছিল না; কিন্তু দেশে তাদের কোনো দৃশ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকলেও এসব টাকার সিংহভাগ ব্যাংকে ডিপোজিট করা হয়েছে। জনতা ব্যাংকের কুমিল্লার বাতাকান্দি শাখায় মো. লিটনের একটি অ্যাকাউন্টে গত বছরের ৩ জানুয়ারি ৩০ লাখ টাকা জমা করা হয়। একই অ্যাকাউন্টে গত ১৬ জানুয়ারি চেকের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। একই অ্যাকাউন্টে ৬ এপ্রিল ১৫ লাখ ও ৩ মে ৫ লাখ ৫০ হাজার, ১৩ জুলাই ৯ লাখ ৫০ হাজার ও ১৬ জুলাই আবার ২০ লাখ টাকা জমা করা হয়।
এ ছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের গৌরীপুর শাখায় মো. লিটনের নামে একটি অ্যাকাউন্টে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি ২০ লাখ, ২৯ জানুয়ারি ২৫ লাখ টাকা জমা হয়েছে। মো. লিটনের নামে একই ব্যাংকে ৩০ লাখ ও ৪০ লাখ টাকার দুটি ফিক্সড ডিপোজিট বা এফডিআর রয়েছে। একই ব্যক্তির নামে ইসলামী ব্যাংকের গৌরীপুর শাখার সেভিংস অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকার তথ্য রয়েছে। আর এক ভাই রিপনের স্ত্রী খাদিজার নামে ইসলামী ব্যাংকে তিনটি ফিক্সড ডিপোজিটের তথ্য পেয়েছে কালবেলা। সেখানে ২ কোটি ১৩ লাখ টাকা জমা রয়েছে। এ ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যদের নামেও বিভিন্ন ব্যাংকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা জমা রয়েছে বলে কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
এর বাইরে রাজধানীর ডেমরার রসুলবাগে সাড়ে সাত শতক জমির উপরে রয়েছে একটি পাঁচতলা বাড়ি। শহিদ নগরে ১০ শতক জমির উপরে একটি টিনশেড বাড়ি ও পাশেই রয়েছে ১০ শতক জমির আরও একটি প্লট। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। গ্রামের বাড়িতে প্রতিবেশীদের উচ্ছেদ করে জমি দখল করে প্রায় ৮০ শতক জমিতে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে তৈরি করেছেন একটি বাগানবাড়ি। যেখানে সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত জমিও রয়েছে। এ ছাড়া সাতানি ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় বিপুল পরিমাণে কৃষিজমি রয়েছে বলে জানা গেছে। যেসব জমি গত ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ক্রয় করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি আরবের আবা শহরের পুলিশ কর্মকর্তা অব্দুর রহমান জাহারানীর ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসা করতেন মো. রিপন। স্ক্রাপের ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ব্যবসার খোঁজ পায় সৌদির আরবের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই প্রতিষ্ঠান। কিছুদিন পরে পাচারকালে ১ লাখ রিয়ালসহ সৌদির পুলিশের কাছে আটক হন রিপন। দীর্ঘ সাত মাস জেল খেটে চলতি বছরের ২৭ জুন জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে দেশে ফেরেন। সৌদি আরবে থাকা রিপনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি কালবেলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কুমিল্লার তিতাসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হঠাৎ টাকার মালিক হয়ে তিন ভাই প্রতিবেশীদের সঙ্গে শুরু করেন বৈরী আচরণ। আওয়ামী সরকারের আমলে তিতাস উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন সরকার, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ ফকির ও সাতানি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হককে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে দুই ভাই বাগিয়ে নেন ছাত্রলীগের পদ। আলাউদ্দিন তিতাস উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আর রিপন সাতানি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগের পদ পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তারা। স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। যখন-তখন যাকে-তাকে ধরে করেন মারধর। এরপর থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে উল্টো মামলা দিয়ে করেন হয়রানি। জমির দখলের জন্য বাড়ির সামনে ডেকে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করেন আপন চাচাতো ভাই সুমনকে। একই সঙ্গে নির্মমভাবে কুপিয়ে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যান সুমনের আরেক ভাই সাইদুল ইসলামকে। হত্যা মামলা করে বিচারের পরিবর্তে ঘরবাড়ি ছাড়া হয় নিহতের পরিবার। এখানেই শেষ নয়, প্রতিবেশীদের যে জমির ওপর চোখ পড়েছে, সেই জমিই দখলে নিয়েছেন তিন ভাই। এর মধ্যে চাচা খেলু মিয়াকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ধারাবাহিকভাবে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। নিজ ভিটেমাটি না ছাড়ায় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয় খেলু মিয়ার অন্তত ৬ লাখ টাকামূল্যের কোরবানির তিনটি গরু। এরপর বাধ্য হয়ে ভিটেবাড়ি ছেড়ে দেন খেলু মিয়া। একইভাবে স্থানীয় ফজলুর রহমান, আবদুর রব, হাকিম, ইসমাইল, কনক বিবি ও ওয়াহেদ আলীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে দখলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জালু মিয়ার বড় ছেলে খুন হওয়া সুমন ছিলেন মালয়েশিয়া প্রবাসী। তার স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভবা। ২০১৭ সালে পরিবারের সঙ্গে ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসেন সুমন। চাচাতো ভাইদের নির্মমতায় খুন হন সুমন। ২০১৭ সালের রমজান মাসে তারাবি নামাজের সময় বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সুমনের ছোট ভাই সাইদুলকে মারধর করতে থাকেন লিটন, রিপন ও আলা উদ্দিনরা। সে সময় পাশেই ব্রিজে দাঁড়িয়ে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন সুমন। ছোট ভাইকে মারতে দেখে এগিয়ে গেলে সুমনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ছেলের চিৎকার শুনে মা সালেহা বেগম এগিয়ে গেলে তাকেও কুপিয়ে আহত করা হয়। চিৎকারে এলাকাবাসী গিয়ে তিন ভাইয়ের নির্মমতা দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিন ভাই দৌড়ে নিজ ঘরে ঢুকলে স্থানীয়রা বাড়িটি ঘিরে রাখেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে তাদের আটক করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন সরকার ও ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ ফকির মীমাংসার জন্য দেনদরবার করেন; দিনভর প্রভাব খাটিয়ে মামলা আটকে রাখেন। মামলা করতে থানায় গিয়ে উল্টো গারদে যেতে হয় সুমনের আত্মীয়স্বজনদের। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে মামলা এজাহারভুক্ত করে আটকৃতদের কোর্টে চালান করতে বাধ্য হয় পুলিশ। এরপর থেকেই প্রভাবশালী ওই দুই রাজনীতিক নিহত সুমনের পরিবারকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। তাতে কাজ না হলে দেন বিভিন্ন প্রলোভন। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্দেশে ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শামসুল হকে সুমনের বাবাকে ইউনিয়ন পরিষদের ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে মামলা মীমাংসা করাতে একটি সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হত্যা মামলার তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে তিন ভাইসহ সহযোগীদের আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মূল হোতাদের দুর্বল ধারায় ফেলায় সেই অভিযোগপত্রে নারাজি দেন বাদী। এরপর আদালত মামলাটি ফের পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। পিবিআইর তদন্তেও ঘটনার সত্যতা মেলে। কুমিল্লা পিবিআইর উপপরিদর্শক (এসআই) মো. নজরুল ইসলাম ২০১৮ সালের ১০ মে তিন ভাইসহ সাতজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৩১ জনকে। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের প্রভাবে রহস্যজনক কারণে মামলায় মাত্র সাতজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে সব আসামিকে খালাস দিয়ে দেন বিচারক।
মামলায় সাক্ষী হওয়া অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে কালবেলা। তারা কালবেলাকে জানিয়েছেন, তারা সবাই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের সামনেই বেপরোয়াভাবে তিন ভাই ও তাদের দোসররা সুমনকে কুপিয়ে হত্যা করে। কুপিয়ে আহত করা হয়েছে সুমনের আরেক ভাই সাইদুল ও মা সালেহা বেগমকে।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের মধ্যে রয়েছেন সাইদুল ইসলাম, রুমি আক্তার, দেলোয়ার হোসেন, মামুনুর রশীদ, ইমান হোসেন, নুর মোহাম্মদ, বাদল মিয়া, ফারুক হোসেন প্রমুখ। তারা কালবেলাকে বলেন, অভিযোগপত্রে সাক্ষী হিসেবে তাদের নাম থাকলেও আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাদের ডাকা হয়নি।
বাদী জালু মিয়া কালবেলাকে বলেন, ‘আমার পোলাডারে চোক্কের সামনে জবাই কইরালাইল, আর এক পোলারে কোপাইয়া ফালাই রাইখা গেল। ছাড়াইতে গিয়া আমার বউডাও কোপ খাইল। কারও কাছে কোনো বিচার পাইলাম না। পারভেজ (উপজেলা চেয়ারম্যান) আমারে বাইত আইসা অস্ত্র দেহাইয়া কয়, চাচা, মিলমিশ না অইলে থাকতারবেন না। আপনিও অস্ত্র মামলা খাইবেন। একটা পোলা মরলেও পোলা তো আরও বাইচা আছে। হেডির কথা ভাইবা মিলমিশ অইয়া যান।’
পরে হাইকোর্টে আপিল করলে অভিযুক্তরা অত্যাচার শুরু করেন জালু মিয়া ও তার পরিবারের ওপর। জালু মিয়ার পুরো পরিবার এখন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যেই গত ১৩ সেপ্টেম্বর জালু মিয়াকে একা পেয়ে বেধড়ক মারধর করেন আসামিরা। এ ঘটনায় মামলা হলে এর সাক্ষী হওয়ার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. মনির হোসেনকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়।
এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর চুরি, লুটপাট ও চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে সাক্ষী মো. মনির হোসেনসহ সাতজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন সুমনের খুনিরা। চাঁদাবাজির এই মামলার এজাহারে সময় উল্লেখ করা হয় ‘৩০ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা’। সে সময় কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা মনির হোসেন তার কর্মস্থল ছিলেন বলে কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন কৃষি ব্যাংকের জুরানপুর শাখার একাধিক কর্মকর্তা। এ ছাড়া মামলার আরও চার আসামি ঘটনার সময় ঢাকায় ছিলেন বলে জানা গেছে তাদের মোবাইল নম্বরের সিডিআর বিশ্লেষণ করে।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে মো. রিপন মিয়া ও মো. আলাউদ্দিনের সঙ্গে মোবাইলে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি। আর মো. লিটন মিয়া ফোন রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে লাইন কেটে দেন। তিনি গাড়িতে আছেন জানিয়ে বলেন, পরে কথা বলবেন। এরপর ফের ফোন দিলে তিনি প্রশ্ন শুনে কোনো উত্তর না দিয়ে পরে ফোন দেবেন বলে লাইন কেটে দেন। এরপর গত দুই দিনেও তিনি তার বক্তব্য দেননি।