হালের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড টপটেন। ফ্যাশনপ্রিয়দের তালিকায় প্রথম সারিতে আছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৩৪টি আউটলেটে দিনভর ভিড় লেগেই থাকে। এ ছাড়া থান কাপড়ে দেশের এক নম্বর ব্র্যান্ড টপটেন। দিনে কয়েক কোটি টাকার বিক্রি কোম্পানিটির। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির যাদের রক্ত ও ঘামে এভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে, সেই দুই সহোদরের সঙ্গেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সৈয়দ হোসেনের ভয়াবহ প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিগত হাসিনা সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজশে নিজের দুই আপন ভাইকে ঠকিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানটি কব্জায় নিয়েছেন সৈয়দ হোসেন।
এখানেই শেষ নয়, আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত থাকলেও আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচার করে সৌদি আরবের রাজধানীতে খুলেছেন টপটেনের শাখা। এ ছাড়া দুবাই, পাকিস্তান ও ভারতে নিয়মিত যাতায়াত করেন সৈয়দ হোসেন। এসব দেশেও তার বিপুল বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। বিদেশে এসব ব্যবসা দেখাশোনায় করেছেন তৃতীয় বিয়ে। কথিত স্ত্রী ঝিনুক নামে এক নারী এসব সম্পত্তি দেখাশোনা করেন বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিন ভাইয়ের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হলেও জাল-জালিয়াতি করে প্রতিষ্ঠানটি একাই কবজায় নিয়েছেন এমডি সৈয়দ হোসেন। স্ত্রীদের পরামর্শে বঞ্চিত করেছেন আপন দুই ভাইকে। নিজেদের অধিকার চাইতে গিয়ে মেজো ভাইয়ের রোশানলে পড়ে জেলে খেটেছেন ৩৫ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক মো. উজ্জ্বল। একাধিক হয়রানিমূলক মামলায় নাজেহাল অবস্থা তার। জেল খেটেছেন তার শ্বশুরও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে বিদেশে অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। এ পর্যন্ত মাত্র ১৭টি কোম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ভ্রমণসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খাতে বছরে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করা যাবে। এর বেশি কোনোভাবেই নেওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পাওয়া ১৭টি কোম্পানির তালিকায় নেই টপটেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে ২০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে টপটেনের শোরুম দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. সৈয়দ হোসেন। রিয়াদের দুলু মার্কেটে রয়েছে টপটেনের এই শোরুম।
টপটেনের কাঁটাবনের আলবারাকা টাওয়ারে বেজমেন্টে গভীর রাত পর্যন্ত চলত প্রভাবশালীদের নিয়ে এমডি সৈয়দ হোসেনের আড্ডা। ভবন ব্যবহৃত হতো সাবেক ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের আড্ডাখানা হিসেবে। রাত হলেই এখানেই ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, পরে
সাদ্দাম-ইনান পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান নারী নেত্রীদের নিয়ে বেসমেন্ট বসাতেন আড্ডার আসর। দিনভর যেখানেই থাকেন না কেন বিকেল হলেই কাঁটাবনের শোরুমে চলে আসতেন প্রতিষ্ঠানটির এমডি সৈয়দ হোসেন। এই আড্ডায় প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন সাবেক রাষ্ট্রপতিপুত্র ও কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। সাবেক এই রাষ্ট্রপতিপুত্রের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করতেন মো. সৈয়দ হোসেন। এরপর সেই অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন। ছাত্রলীগের নেতাদের নিজের বশে রাখতে টপটেনের বরিশাল শাখাটি উপহার হিসেবে দিয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান জয়কে। টপটেনের ওই শাখাটি জয়ের নামে পরিচালিত হয়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান, রাজশাহী সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, কুমিল্লার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল সৈয়দ হোসেনের। নিয়মিত যাতায়াত করতেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিন্টু রোডের কার্যালয়ে। সৈয়দ হোসেন ও সাবেক ডিএমপির ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদের বাড়ি একই এলাকায় কিশোরগঞ্জে হওয়ায় তাদের মধ্যে ছিল গভীর সখ্য। নিজের দুই ভাইকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করতে এই হারুনের সহযোগিতা নিতেন তিনি। এ ছাড়া মামলার পরে আদালতে পক্ষে রায় নিতে সহায়তা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
জানতে চাইলে টপটেনের ৩৫ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক মো. উজ্জ্বল কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের অর্থে তিনি (সৈয়দ হোসেন) নিজের নামে সম্পদ গড়েছেন। ৩০০ কোটি টাকার ওপরে তিনি কোম্পানি থেকে লুট করেছেন। প্রতিবাদ করায় আমাকে কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছেন, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন। কোম্পানির টাকায় সৌদি আরবের রিয়াদের টপটেন শাখা খুলেছেন। ৩৫ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার হওয়ার পরও আমাকে কোম্পানিতে ঢুকতে দেন না, লভ্যাংশের ভাগও দেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘টপটেন গ্রুপের মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি। কোনো কোম্পানির বোর্ডের কোনো এজিএম হয় না। সৈয়দ হোসেন অবৈধভাবে সবগুলো প্রতিষ্ঠানের এমডির পদ দখল করে আছেন।’
এসব বিষয়ে জানতে টপটেনের এমডি সৈয়দ হোসেনকে ফোন দেওয়া হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন। এরপর প্রশ্ন লিখে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।