আগে থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়ে রেখেছে ডেঙ্গু। এ পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন করে ভয় জাগাচ্ছে জিকা ভাইরাস ও চিকুনগুনিয়া। কারণ দেশে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত ১১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। পাওয়া গেছে ৬৭ জন চিকুনগুনিয়া রোগীও। সম্প্রতি ডেঙ্গু শনাক্ত করতে গিয়ে এ দুটি ভাইরাসের তথ্য মিলেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ দুটি রোগও ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। কিন্তু এসব রোগ শনাক্তে আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে। ডেঙ্গুর মধ্যেই জিকা ভাইরাস ও চিকুনগুনিয়ার চোখ রাঙানি উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। যদিও আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এ দুটি রোগে ঠিক কত মানুষ সংক্রমিত হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। দেশে যদি জিকা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। পাশাপাশি দেশে নতুন মহামারির উদ্ভব হবে। কারণ জিকা ভাইরাসের সুনির্দিষ্ট লক্ষণ নেই। এমনকি প্রতিষেধকও নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আক্রান্তের ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে শরীরে লালচে দানার মতো ছোপ বা র্যাশ, হালকা জ্বর, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ থেকে পানি পড়া, মাংসপেশি এবং গিঁটে গিঁটে ব্যথা, অবসাদ ও মাথাব্যথা হতে পারে। এসব লক্ষণ সর্বোচ্চ ২ থেকে ৭ দিন থাকতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোনো নারী জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শিশুর মাইক্রোকেফালি (স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট মাথা), চোখের সমস্যা, শ্রবণজনিত সমস্যা হতে পারে। এমনকি অপরিণত শিশুর জন্ম (প্রিটার্ম বেবি) এবং গর্ভের শিশুর জীবনাবসান পর্যন্ত হতে পারে। জিকা ভাইরাস সংক্রমণে শিশু ও বড়দের আরও কিছু রোগের ঝুঁকি থাকে, যেমন গুলেন বারি সিনড্রোম। এ ছাড়া অন্যান্য স্নায়বিক রোগের ঝুঁকিও আছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন জানান, এডিস মশার মাধ্যমে জিকা ভাইরাস ছড়ায়। এ মশার মাধ্যমেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ইয়েলো ফিভারও ছড়ায়। রক্ত পরিসঞ্চালন এবং অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও এটি ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মধ্যে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তাতে গর্ভের শিশুও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গর্ভের শিশুর জন্য বিষয়টি মারাত্মক জটিলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, এ বছর সারা দেশে ১১ জন জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করেছে। এ ছাড়া ৬৭ জনের নমুনায় চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম জিকা ভাইরাস ধরা পড়ে ২০১৪ সালে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে পাঁচজন জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। যদিও বিষয়টি সাধারণের অজানা ছিল। গত তিন মাসে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। জিকার দুটি ধরন এশিয়ান ও আফ্রিকান। বাংলাদেশে পাওয়া রোগের ধরন এশিয়ান, যা প্রায় ৯ বছর পর পাওয়া গেল।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর জানান, ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষা করতে গিয়ে এ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জিকা ও চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুহার কম। জিকা ভাইরাসে আক্রান্তদের ৯০ শতাংশর ক্ষেত্রেই কোনো লক্ষণই দেখা দেয় না। জিকা ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের অধিকাংশ ঢাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন কালবেলাকে বলেন, এডিস মশার বিস্তার যত বাড়বে, ডেঙ্গুর সঙ্গে জিকা ভাইরাস ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবও তত বেশি লক্ষ করা যাবে। তিনি বলেন, আতঙ্কিত না হয়ে মশা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে এডিসের প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। অন্যথায় এসব রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকানো যাবে না।
প্রতিরোধ ও প্রতিকারের পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, জিকা ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। তাই নিজেদের সচেতনতা জরুরি। রাতে তো অবশ্যই, দিনেও মশারি ব্যবহারের অভ্যাস করতে হবে। প্রয়োজনে জানালায় মশানিরোধী জাল ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশুদের ক্ষেত্রে এটা বেশি প্রয়োজন। তিনি বলেন, জিকায় আক্রান্ত হলে বিশ্রাম এবং বেশি বেশি তরল খাবার খেতে হবে। গিঁটে বা শরীরে ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খেতে হবে।
জানা যায়, ১৯৪৭ সালে প্রথম উগান্ডায় জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়। ভাইরাসটি পাওয়া গিয়েছিল রেসাস ম্যাকাও বানরের শরীরে। পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশের দশকে আফ্রিকান দেশগুলোতে মানুষের শরীরেও এই জীবাণু মেলে। ১৯৬০-৮০ সালের মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ ভাইরাস।