টাঙ্গাইলে বাসার সামনেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ড্যান্ট পুলিশ সুপার মো. ইমামুর রশীদ। ছিনতাইকারী তার মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নিয়েছিল। গত ১৮ অক্টোবর সকালের ওই ঘটনার পরদিনই অবশ্য তার ফোনটি উদ্ধার হয়। বছরখানেক আগে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় নিজের মোবাইল ফোন খোয়া গেলে থানায় জিডি করেছিলেন সূচনা ধর নামে এক নারী। এখনো তার ফোনটি উদ্ধার হয়নি।
শুধু পুলিশের এই কর্মকর্তা বা সূচনা নন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতি মাসে গড়ে ১৮ হাজার ৫০৭টি মোবাইল ফোন বেহাত হচ্ছে। এসব ঘটনার প্রায় সবকটিতেই হারানোর জিডি (সাধারণ ডায়েরি) হয়েছে। যদিও হারানো জিডির সূত্রে পুলিশ মাসে গড়ে প্রায় ৩ হাজার ২০০ মোবাইল ফোনসেট উদ্ধার করতে পারছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুরি, পকেটমার ও ছিনতাই হলেও পুলিশের খাতায় তা হারানোর জিডি হিসেবে তালিকাভুক্ত হচ্ছে।
এত বেশিসংখ্যক মোবাইল ফোন চুরি-ছিনতাই ঠেকাতে পুলিশ সদর দপ্তর সম্প্রতি নড়েচড়ে বসেছে। এরই মধ্যে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটে মোবাইল চুরি ও ছিনতাইয়ের সিন্ডিকেট ভাঙতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি হারানো মোবাইল ফোন উদ্ধারে পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে বলা হয়েছে। চোরাই মোবাইল ফোন বিক্রির স্থানগুলো চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযান চালাতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে ৫৫ হাজার ৫২২টি মোবাইল ফোন বেহাত হয়েছে। সে হিসেবে মাসে গড়ে ১৮ হাজার ৫০৭টি এবং দিনে গড়ে ৬১৫টি মোবাইল ফোন বেহাত হচ্ছে। এ ঘটনায় ওই তিন মাসে মামলা হয়েছে মাত্র ৩৭টি। তবে হারানোর জিডি হয়েছে ৫৫ হাজার ৪৮৫টি। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, এত বেশিসংখ্যক মোবাইল ফোন বেহাত হলেও উদ্ধার একেবারে কম। তিন মাসে মাত্র ৯ হাজার ৭৩১টি ফোনসেট উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৩ হাজার ২৪৩টি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ তালেবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে কারও মোবাইল ফোন খোয়া গেলে বা চুরি হলে সেভাবেই আইন অনুযায়ী মামলা নেবে থানা। সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে মামলা করতে হবে এবং পুলিশও আইন অনুযায়ী মামলা নেবে। হারিয়ে গেলে জিডি হবে—এটা স্বাভাবিক।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত জুলাই মাসে সারা দেশে মোবাইল ফোন হারানোর জিডি হয় ১৮ হাজার ৬৫৩টি। পাশাপাশি ছিনতাই বা চুরির ঘটনায় মামলা হয় ২৯টি। ওই মাসে পুলিশ বেহাত হওয়া ৫ হাজার ২৫৬টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। পরের মাসে হারানোর জিডি হয় ১৩ হাজার ৯৪৪টি এবং মামলা হয় মাত্র দুটি। তবে উদ্ধার করা হয় মাত্র ১ হাজার ৭৫৮টি। গত সেপ্টেম্বরে সারা দেশের থানাগুলোতে হারানোর জিডি হয় ২২ হাজার ৮৮৮টি, মামলা হয় মাত্র ৬টি। আর উদ্ধার হয় ২ হাজার ৭১৭টি।
গত ১১ নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় হারানো মোবাইলের জিডি নিষ্পত্তির বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) মো. আকরাম হোসেন বলেন, হারানো মোবাইল ফোনের বিষয়টি নিয়ে পুলিশের সব ইউনিটকে অ্যানালাইসিস করে কাজ করতে হবে। চোরাই মোবাইল যে জায়গায় বিক্রি হয়, সেই জায়গাগুলোকে যদি চিহ্নিত করা না যায়, তবে চুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তিনি মোবাইল চুরি বা ছিনতাইয়ের সিন্ডিকেট ভাঙার নির্দেশ দিয়ে বলেন, হারানো মোবাইল উদ্ধার ও চোরাই মোবাইল বিক্রির স্থান চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে।
একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইল ফোন ছিনতাই হলে থানা পুলিশ ছিনতাই মামলা নিতে অনেক ক্ষেত্রে অনীহা দেখায়। হারানো জিডি করতে উৎসাহিত করা হয়। পাশাপাশি ভুক্তভোগীও থানা ও আদালতে যাতায়াতের ঝামেলা এড়াতে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েও হারানো জিডি করে। এতে মোবাইল ফোন ছিনতাই হলেও পুলিশের খাতায় তা হারানো হিসেবেই লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে।
থানা পুলিশ ছাড়াও ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ছিনতাই, চুরি বা হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন উদ্ধারে কাজ করে আসছে। এ বিভাগগুলোর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ মোবাইল ফোন বেহাত হলে এগুলোর আইএমআই নম্বর বদলে ফেলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এতে এসব মোবাইল ফোন সক্রিয় থাকলেও তা আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দামি ফোনসেটগুলো দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশের বাইরে নিয়ে এসব ফোন সচল করলে তা আর ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।