জটিল ও কঠিন রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকরা রোগীদের সিটিস্ক্যান ও এমআরআই পরীক্ষা করার পরামর্শ দিলেও দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে এসব সেবা সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সেগুলোতে স্থাপন করা সিটিস্ক্যান ও এমআরআই যন্ত্রের প্রায় অর্ধেকই অচল অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে সেবা পেতে রোগীদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিকে ছুটতে হচ্ছে। এতে তাদের অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয় দুই থেকে আড়াইগুণ। সঙ্গে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের ২৩ সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিটিস্ক্যান যন্ত্র আছে ৩১টি। এর মধ্যে সচল রয়েছে ২০টি, অচল অবস্থায় পড়ে আছে ১১টি। এই ২৩ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এমআরআই যন্ত্র আছে ২৪টি। এর মধ্যে সচল ১৪টি, অচল ১০টি। অর্থাৎ মেডিকেল কলেজগুলোর প্রায় অর্ধেকসংখ্যক সিটি স্ক্যান ও এমআরআই যন্ত্রই অচল।
এদিকে দেশের ১৮ বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে সিটিস্ক্যান যন্ত্র ১৭টি, এর মধ্যে ৭টি অচল। এসব প্রতিষ্ঠানে এমআরআই যন্ত্র আছে ৯টি, যার চারটি অচল। এ ছাড়া দেশের ৬১টি জেলা সদর হাসপাতালে সিটিস্ক্যান যন্ত্র আছে মাত্র ১০টি, যার একটি অচল এবং ৩টি এমআরআই যন্ত্রের ১টি অচল। এ ছাড়া জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত সিটিস্ক্যান যন্ত্রটি ডিএনসিসি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেটির কোনো ব্যবহার হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, অচল যন্ত্রগুলোর মধ্যে কিছু আছে, যা আর কখনোই সচল হবে না। কিছু আছে, সেগুলো মোরামত করে পুনরায় সচল করা সম্ভব। তবে অচল যন্ত্রের অর্ধেকই মেরামত অযোগ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জটিল ও কঠিন রোগ নির্ণয়ে সিটিস্ক্যান ও এমআরআই পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এসব পরীক্ষার সুবিধা থাকলে রোগীদের সাশ্রয় হয়; কিন্তু সরকারি হাসপাতালে যন্ত্র বিকল থাকায় রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েন। বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এসব পরীক্ষা করাতে দুই থেকে আড়াইগুণ অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয়।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে সিটিস্ক্যান করাতে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা ফিস দিতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালে এক্ষেত্রে দিতে হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। চেস্ট সিটিস্ক্যান করাতে সরকারি হাসপাতালে ফিস দিতে হয় ৩ হাজার টাকা, বেসরকারিতে ছয় থেকে আট হাজার টাকা। একইভাবে ব্রেনের সিটিস্ক্যান করাতে সরকারিতে লাগে ২ হাজার বেসরকারিতে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। অন্ত্রের পূর্ণ সিটিস্ক্যান করাতে সরকারি ব্যয় ৪ হাজার টাকা, বেসরকারিতে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তবে কোনো রোগীর কন্ট্রাস্ট (ওষুধ) প্রয়োজন হলে এর সঙ্গে আরও ২ হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে।
একইভাবে সরকারি হাসপাতালে স্পাইন, ব্রেইন, নি-জয়েন্ট ইত্যাদির সিটিস্ক্যানে ব্যয় ৩ হাজার টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় হয় সাত থেকে ১০ হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালে হোল অ্যাবডোমিন এমআরআই করাতে ব্যয় ৪ হাজার টাকা, বেসরকারি হাসপাতালে ১৪ হাজার টাকা।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানা গেছে, একটি সিটিস্ক্যান বা এমআরআই যন্ত্রে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ জন রোগীর পরীক্ষা করা হয়; কিন্তু অর্ধেক যন্ত্র নষ্ট থাকায় বিপুলসংখ্যক রোগী এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, মেরামতযোগ্য যন্ত্রগুলোর সচল না হওয়া আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এসব যন্ত্রের বিক্রয়োত্তর সেবার মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছে। নিয়মানুযায়ী সরকার এবং বিক্রেতা/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশেষ চুক্তি (সিএমসি-কমপ্রিহেন্সিভ মেইনটেনেন্স কন্ট্রাক্ট) হয়ে থাকে। সেই চুক্তির আলোকে বিক্রেতা/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময় বিক্রয়োত্তর সেবা দিয়ে থাকে; কিন্তু বর্তমানে কোনো সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিএমসি করতে রাজি হচ্ছে না। কারণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে যন্ত্রের ক্রয় মূল্যের সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে সিএমসি; কিন্তু যন্ত্রগুলো পুরোনো হওয়ায়, কেনার সময়ের তুলনায় বর্তমানে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত হারে সিএমসি করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। মন্ত্রণালয় ও বিক্রেতাদের অনড় অবস্থায় যন্ত্রগুলোর স্বাভাবিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এতে বাড়ছে রোগীদের দুর্ভোগ।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, মেরামত উপযোগী যন্ত্রগুলো মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমআরআই যন্ত্রটি মেরামতের ব্যবস্থা হয়েছে। অপারেশনাল প্ল্যান অনুমোদন না হওয়ায় অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, দিনাজপুরে একাধিক ক্যাথল্যাব অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেগুলো চট্টগ্রাম বা মুগদা স্থানান্তর হতে পারে। সিএমসি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মন্ত্রণালয় নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি সিএমসি দাবি করছে। মেরামতের ব্যয় দিয়ে যদি নতুন যন্ত্র কেনা যায় তাহলে সে ধরনের সিদ্ধান্তই নিতে হবে।