গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইসলামী দলগুলোর কর্মতৎপরতা বেড়েছে। আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানাভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে সংগঠনগুলো। যার যার অবস্থান থেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করছে বিভিন্ন ইসলামী দল। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যস্ত দলগুলোর নেতাকর্মীরা। নতুন প্রেক্ষাপটে একটি ‘নির্বাচনী ঐক্য’ গড়তে বিভিন্ন ইসলামী দল পারস্পরিক যোগাযোগও বাড়িয়েছে। বিশেষত ইসলামী কয়েকটি দলের সঙ্গে ‘নির্বাচনী ঐক্য’ গড়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়তে চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সরকার পরিবর্তনের পর দলটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে মতবিনিময় করেছে, যার মধ্যে পাঁচটি ইসলামী দল এবং আলেম সমাজ রয়েছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও নির্বাচনের ব্যাপারে কৌশলে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে গতকাল শুক্রবার বরিশালের চরমোনাইর বার্ষিক মাহফিলে অংশ নিয়ে নতুন জোট গড়ার কথা জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। গতকাল শুক্রবার তিনি কালবেলাকে বলেন, আমাদের দলের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করার। এজন্যই সবার সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এখনই নতুন জোট করার বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী নির্বাচনে জোটবদ্ধ নাকি আলাদা অংশ নেওয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ—এমনটা বিবেচনায় নিয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধাকরা অন্য ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়তে চাইছেন। এ লক্ষ্যে দলটি যোগাযোগ বাড়িয়েছে। তবে নির্বাচনী ঐক্য গড়ার বিষয়টি এখনো দৃশ্যমান নয়। চূড়ান্ত রূপ নিতে আরও সময় লাগবে বলে সূত্র জানায়। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দলের নেতারা জানান, জামায়াতের সঙ্গে তাদের আদর্শগত কিছু মতানৈক্য রয়েছে, যে কারণে ঐক্য গড়তে বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য গড়তে কোনো বাধা হবে না। কেননা, জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী ঐক্য শক্তিশালী হবে না বলে অধিকাংশের মত।
সবকিছু ঠিক থাকলে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর কোনটা কী ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ইসলামী দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোট গড়বে নাকি স্বতন্ত্রভাবে অংশ নেবে, নাকি নতুনভাবে জোট গড়ে নির্বাচনে যাবে, সেটি এখনো অস্পষ্ট। তবে একই প্ল্যাটফর্মে আসার ব্যাপারে ইসলামী দলের নেতারা বসে নেই।
জানা যায়, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামী রাজনৈতিক দল ১০টি। এর মধ্যে কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক দল ছয়টি। এগুলো হলো—ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ছাড়া বাকি পাঁচটি দলই একসময় বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। এখন এই দলগুলোর মূল কোনো অংশই বিএনপির সঙ্গে নেই। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট নামে দুটি খণ্ডিত অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে, যাদের নিবন্ধন নেই। নিবন্ধনের বাইরে সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
বিভিন্ন ইসলামী দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, অধিকাংশ ইসলামী দল পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনাও রয়েছে। এ বিষয়ে এখনই মুখ খুলছেন না তারা।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার কালবেলাকে বলেন, সমমনা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিভিন্ন সংশোধন ও সংস্কারে ন্যূনতম একটা সময় লাগবে সরকারের। নতুন জোট গঠনের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুছ আহমাদ বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সমমনাদের নিয়ে জোট গঠনের কার্যক্রম অনেক আগে শুরু করেছি। বৃহস্পতিবার কয়েকটি দলের নেতারা চরমোনাইয়ে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে গিয়ে সংহতির কথা জানিয়েছেন। এর ফলে জোট গঠনের উদ্যোগ আরও একধাপ এগিয়ে গেল। ভিপি নুর প্রথমবার চরমোনাইয়ে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে মাহফিলে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে জোট গঠনের ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে আলোচনার আরও অনেক সুযোগ আছে। দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনী আবহ এখনো তৈরি হয়নি। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের উদ্যোগ আছে। তবে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। সব রাজনৈতিক দল যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যেও সমমনা ইসলামী দল ও আলেমরা বৈঠক করেছেন। আমাদের সঙ্গে সম্প্রতি কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের মতবিনিময় হয়েছে। সেখানে আলোচনা হয়েছে, আগে নিজেদের ঐক্য গড়তে হবে। এরপর কার সঙ্গে ঐক্যে যাওয়া যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
খেলাফত মজলিসের (দেয়াল ঘড়ি) মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের কালবেলাকে বলেন, ইসলামী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী ঐক্য গড়ার উদ্যোগ আছে। যেহেতু নির্বাচনের সুস্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, সুতরাং নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলে বা আবহ তৈরি হলে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হবে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক সম্প্রতি বলেছেন, ঐক্যের বা আলোচনার মূল সূত্র হচ্ছে, মতভিন্নতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামের যে বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই। আবার যেগুলো চাই না, সেই অপতৎপরতাকে মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে আলোচনা যেভাবে হয়, সেটাই হবে।
ভিপি নুরের নেতৃত্বে নতুন জোট: আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জোটের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বে এ জোট হচ্ছে। ধর্মভিত্তিক দলের বাইরে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর তিনি বরিশালের চরমোনাইয়ে চলমান ওয়াজ মাহফিলে ছিলেন। এ সময় বক্তব্যে আগামী নির্বাচনে পীরের নেতৃত্বাধীন ভোটের জোটে থাকার আভাস দিয়েছেন। আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের শীর্ষ নেতা বৃহস্পতিবার চরমোনাই মাহফিল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ওলামা-মাশায়েখ সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন। তাদের বক্তব্যেও আগামী নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। তবে আগের মাহফিলগুলোতে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল অংশ নিলেও এবার কেউ যাননি। যাননি জামায়াতে ইসলামীর কেউ।
প্রতি বছরের মতো গত বুধবার চরমোনাই দরবারে তিন দিনের বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল শুরু হয়। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জাতীয় নেতা ও স্থানীয় প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ইসলামী আন্দোলনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীও চরমোনাইয়ে উপস্থিত থাকেন। এ সময় দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর এবারের মাহফিলের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় প্রস্তুতির পাশাপাশি জোটের প্রস্তুতিও নিচ্ছে ইসলামী আন্দোলন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বুধবার ফজরের নামাজের আগে সড়কপথে চরমোনাইয়ে পৌঁছান গণঅধিকারের সভাপতি নুরুল হক নুর। এই প্রথম তিনি চরমোনাইর মাহফিলে অংশ নেন। ফজরের নামাজের পর তাকে পাশে বসিয়ে মুসল্লিদের উদ্দেশে ধর্মীয় বয়ান করেন পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। এর আগে মঞ্চে নুরকে টুপি পরিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় ও মুসল্লিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন দলটির আমির।
মাহফিলে অংশ নিয়ে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাসিত আজাদ বলেন, ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হবো। খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন মিয়াজী বলেন, চরমোনাই পীর ও আল্লামা মামুনুল হক একসঙ্গে বসেছেন, হাতে হাত রেখে একত্রে পথচলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যদের অবজ্ঞা করা যাবে না। ছোটখাটো বিরোধের কারণে নতুন করে দেশ গড়ার সুযোগ থেকে যাতে আমরা বঞ্চিত না হই।
ইসলামী আন্দোলনের মিডিয়া সেলের সদস্য কে এম শরীয়ত উল্লাহ জানান, ২৬ নভেম্বর বরিশাল নগরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে বিভাগীয় কওমি মাদ্রাসা ঐক্য পরিষদের মহাসম্মেলনে চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল ও খেলাফত মসলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক একই মঞ্চে বক্তব্য দিয়ে ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার চরমোনাইর কর্মসূচিতে কয়েক দলের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন।