ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি, ঋণের মান কমে যাওয়া, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো একদিকে দুর্বল হয়, অন্যদিকে আর্থিক ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। এ কারণে এতদিন ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কম দেখানো হতো। তবে অর্থনীতির ক্ষত ও বর্তমান পরিস্থিতি জানতে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে ঢের বেশি এই ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ডিসট্রেসড অ্যাসেট বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। তবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি সূত্র বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, শ্বেতপত্র হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন শেষে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ছুঁতে হতে পারে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য দিয়েছে, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির হিসেবে ঝুকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ তার থেকে অনেক বেশি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অর্থনীতির ক্ষত ও বর্তমান পরিস্থিতি জানতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা, পর্যালোচনা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর ইতোমধ্যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। ওই প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের রক্তক্ষরণের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হবে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও অনিয়মের জন্য ব্যাংকগুলোতে করপোরেট গভর্ন্যান্সের অভাব এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এ খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দ্বৈত শাসন চলেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকছে।
নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থায় দ্বৈত শাসনের ফলেই ব্যাংক খাতে নানা অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব তৈরি হয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের রক্তক্ষরণ না হয়, সেজন্য ব্যাংক খাতে চলমান দ্বৈত শাসনের ব্যবস্থা বাতিল করে একক নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা এবং শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এখতিয়ার সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
শুধু ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ কম দেখানো নয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের খেলাপি ঋণের পরিমাণও কম দেখানো হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির পর্যালোচনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা গত জুনে ছিল ২ লাখ ১১ হাজর কোটি টাকা।
তবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির হিসাবে এই খেলাপির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপির অনেক তথ্য গোপন করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠীর ঋণ খেলাপি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সেসব ঋণকে খেলাপি দেখাতে মানা করতেন বলেও জানতে পেরেছে কমিটির সদস্যরা। এ কারণে এস আলম গ্রুপ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিতে পেরেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে বলে জানা গেছে।
খেলাপি ঋণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কম দেখানোর বিষয়টি অবহিত করে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, প্রতিবেদন প্রকাশের আগে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বাড়তে পারে। কারণ আগের সরকারের আমলে খেলাপি ঋণসহ ব্যাংকের খারাপ সম্পদ গোপন করার একটা বড় প্রবণতা ছিল। এ কারণে ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কম দেখানো হয়েছে। কিন্তু নতুন সরকারের মধ্যে এসব তথ্য লুকানোর ইচ্ছা নেই বা থাকার কারণও নেই। এজন্য লুকিয়ে রাখা তথ্যগুলো বেরিয়ে আসছে। অর্থাৎ আগামীতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও শ্বেতপত্রে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।
শ্বেতপত্র কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তিন মাস ধরে প্রস্তুত করা অর্থনীতির শ্বেতপত্রের প্রতিবেদন আগামীকাল রোববার দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হবে। এর পরের দিন সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির ওয়েভসাইটে প্রতিবেদনটি আপলোড করা হবে।
‘হোয়াইট পেপার অন দ্য স্টেট অব ইকোনমি’ নামে প্রতিবেদনটি ইংরেজি ভাষায় তৈরি করেছে কমিটি। তবে বাংলায় অনুবাদ করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ বিষয়ে কমিটির এক সদস্য কালবেলাকে বলেন, প্রতিবেদনটি ইংরেজি ভাষায় তৈরি করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, প্রতিবেদনটি বাংলায় করতেই হবে। প্রথমে ইংরেজিতে থাকবে, তবে পরে এটি বাংলায় অনুবাদ করা হবে বলে জানান তিনি।
শ্বেতপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, এটা একটা টিমওয়ার্ক। কোনো একটি খাত ধরে কাজ করা হয়নি, বিষয়বস্তু ধরে ধরে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। একেকজন একেক বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেগুলো আবার তিন দফায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যাচাই-বাছাই করে ফাইনাল ড্রাফট প্রস্তুত করা হয়েছে। শ্বেতপত্র তৈরিতে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করা ছাড়াও অংশীজনের মতামত নেওয়া হয়েছে। তবে শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক খাতের রক্তক্ষরণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুটপাটের ফিরিস্তি এবং অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে। এ ছাড়া ব্যক্তি স্বার্থে কর অব্যাহতি, মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে সরকারি পরিসংখ্যানের বিকৃতি এবং সরকারের ঋণের চিত্র তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প, ব্যবসার পরিবেশ, দারিদ্র্য ও সমতা, পুঁজিবাজার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ও জলবায়ু ইস্যুসহ ২২টি অধ্যায় থাকবে।
জানা গেছে, শ্বেতপত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ থাকবে অর্থ পাচার নিয়ে। কমিটি জানতে পেরেছে, বিগত ১৫ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে, অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাচারের অঙ্কও বেড়েছে। আরও অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং এই প্রবণতা বন্ধে সরকারকে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করবে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
সরকারি নথি ও বৈশ্বিক প্রতিবেদন ব্যবহার করে অর্থ পাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়েছে। তবে সময় স্বল্পতার কারণে অর্থ পাচারের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি বলে কমিটি সূত্রে জানা গেছে। এর আগে গত ২ নভেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানায়, ১৫ বছর ধরে প্রতি বছর দেশ থেকে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
বিগত সরকারের সময় নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিবর্গকে বিপুল পরিমাণ কর অব্যাহতি দেওয়া হয়, এ বিষয়েও শ্বেতপত্রে তথ্য থাকছে। এসব কর অব্যাহতির ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিটি। রাজস্ব আহরণে অটোমেশন বাস্তবায়িত না হওয়া, রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং নীতি বাস্তবায়নে পৃথক সংস্থা করার আইন কার্যকর না হওয়া বিষয়গুলোরও বর্ণনা থাকবে কমিটির প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া আগের সরকারের সময় অর্থনীতির বিভিন্ন পরিসংখ্যানে গরমিলের বিষয়েও উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে শ্বেতপত্রে। এতে বলা হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হারসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিকৃত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে পরিসংখ্যানের বিকৃতি রোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) একটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারকে সুপারিশ করেছে কমিটি।
চলতি বছরের ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। বছরের পর বছর ধরে চলা অব্যবস্থাপনা ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ধোঁয়াশায় জর্জরিত অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানাতে প্রতিবেদন তৈরিতে এই কমিটিকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। কমিটি গঠনের পর সরকারপক্ষ থেকে জানানো হয়, শ্বেতপত্রে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ, এসডিজি বাস্তবায়ন ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিফলন থাকবে।