চলমান বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে চলছে স্থবিরতা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতিসহ নানা কারণে সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতি। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দিয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। ধীরগতির কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্পগুলোতে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবরে গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে সরকার বড় ধরনের কাটছাঁট করতে চায়। তারই প্রভাব পড়েছে এডিপি বাস্তবায়নে। এমন মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও কাটছাঁটের প্রভাব পড়েনি বড় বরাদ্দ পাওয়া এলজিইডির প্রকল্প ও সড়কে। বরাবরের মতোই উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রোববার চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসের এডিপি বাস্তবায়নের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে আইএমইডি। তাতে দেখা যায়, চার মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর চেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য সংস্থাটির ওয়েবসাইটে নেই।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ১ হাজার ৩৫২ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ৫৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এসব প্রকল্পের বিপরীতে খরচ হয়েছে মাত্র ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন।
গত অর্থবছরের একই সময়ে ৩১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা ছাড় হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছাড় হয়েছিল ৩২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। শুধু গত অক্টোবর মাসে অর্থছাড় হয়েছে ৮ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরের অক্টোবর মাসে ছাড় হয়েছিল ১১ হাজার ৮২ কোটি টাকা।
আইএমইডির ওয়েবসাইটে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্য পাওয়া যায়। সেখানো কোনো অর্থবছরই এডিপি বাস্তবায়ন হার সাড়ে ১১ শতাংশের কম ছিল না। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) বাস্তবায়ন হার ছিল ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১৩ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কাটছাঁট হতে পারে। তাই বেশি প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোতে অর্থছাড় করা হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রাধিকার যাচাই-বাচাই করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ধরা হয় ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, এডিপিভুক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থবিরতার মূল কারণ হলো চাহিদামতো অর্থছাড় না হওয়া। এখন কোনো প্রকল্প প্রয়োজনীয় বা কোনো প্রকল্প রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়েছিল সেগুলোর যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে এডিপি বাস্তবায়ন হার কম হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের বর্তমান স্থবিরতার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্পগুলোতে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রথম চার মাসে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তার প্রভাবে আগামীতে অবস্থা আরও খারাপ হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে গিয়ে বেশ ঝামেলা হবে। শেষ পর্যন্ত মেয়াদ ও সঙ্গত কারণেই ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হবে। ফলে এই সরকারের উচিত দ্রুত প্রকল্পগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করে দেওয়া। এতে নেতিবাচক পরিস্থিতির কিছুটা অবসান ঘটবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে আছে, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হচ্ছে। ফলে সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে অপচয়মূলক ব্যয় কমানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে খরচ কমানোর বড় জায়গা হচ্ছে এডিপি। প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় বরাদ্দ দিতে হবে। যেসব মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো সেগুলো শেষ করা ভালো হবে। তবে যেসব মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি বা প্রাথমিক ধাপে আছে সেগুলো বাদ দেওয়া ভালো হবে।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সবচেয়ে বেশি ৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকা অর্থ খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এরপর সর্বোচ্চ খরচ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ, ৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ খরচ করেছে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খরচ করছে ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। ১ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা খরচ করেছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। ১ টাকাও খরচ করতে পারেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে কাজের গতি বাড়েনি। বড় মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচ করেছে এই দুইটি বিভাগ। চার মাসে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ খরচ করেছে মাত্র ২ দশমিক ৪২ শতাংশ বা ২৬৯ কোটি টাকা। আর স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ খরচ করেছে মাত্র শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ বা ২ কোটি টাকা। এ ছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ খরচ করেছে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ খরচ করেছে ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ।