আওয়ামী লীগ আমলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) খণ্ডকালীন সদস্য হয়েছিলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জুলহাস উদ্দিন। আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদে ২০১৯ সালে বুটেক্সের তিন সদস্য বিশিষ্ট উপাচার্য (ভিসি) প্যানেলের দুই নম্বরে ছিলেন এই অধ্যাপক। সাধারণত, ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীরাই ইউজিসির খণ্ডকালীন সদস্য কিংবা উপাচার্যের প্যানেলে থাকেন। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং আওয়ামী লীগের আমলে বঞ্চিত উল্লেখ করে উপাচার্য বনে যান অধ্যাপক জুলহাস উদ্দিন। বিষয়টি নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং সাবেক শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইনের স্বাক্ষর সংবলিত বুটেক্সের উপাচার্য প্যানেল অনুমোদনের চিঠি রয়েছে কালবেলার কাছে। তাতে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে বুটেক্সের উপাচার্য নিয়োগের জন্য তিন সদস্যের প্যানেল পাঠানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। সেই তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম, দুই নম্বরে ছিলেন অধ্যাপক ড. মো. জুলহাস উদ্দিন এবং তিন নম্বরে ছিলেন ফ্যাব্রিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ আলিমুজ্জামান। শেখ হাসিনা তালিকার এক নম্বরে থাকা অধ্যাপক আবুল কাশেমকে উপাচার্য হিসেবে অনুমোদন দেন। এরপর ওই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর করেন এবং প্রক্রিয়া শেষে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বুটেক্স তেজগাঁওয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্বাচনী এলাকায় হওয়ায় তিনি অধ্যাপক জুলহাস উদ্দিনকে উপাচার্য বানাতে ডিও লেটার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও ডিও লেটার দেন। ড. রাজ্জাক ও অধ্যাপক জুলহাস দুজনের বাড়ি টাঙ্গাইলে। ডিও লেটারের পর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও তিনি আওয়ামী লীগের অনুসারী প্রমাণিত হয়।
অধ্যাপক জুলহাসের একাধিক সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুটেক্স টেক্সটাইল কলেজ থাকা অবস্থায় তিনি কখনোই ছাত্রদলের রাজনীতি করেননি। তবে জাতীয়তাবাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি পদে তিনি দুইবার নির্বাচন করে প্রতিবারই বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। অবশ্য অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছবি তুলেছেন। নির্বাচনে হেরে যাওয়া এবং সেই ছবিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করেন এই অধ্যাপক। নিজেকে সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বিএনপির অনুসারী বলে দাবি করতে থাকেন।
বুটেক্সের দুজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী কালবেলাকে বলেন, জুলাইয়ের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা আসার পর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো মাঠে নামেন বুটেক্সের শিক্ষার্থীরা। সে সময় শুধু জুলহাস স্যার নন, ঊর্ধ্বতন প্রশাসন কিংবা জ্যেষ্ঠ কোনো অধ্যাপকের সমর্থন আমরা পাইনি। তাদের আন্দোলনে সমর্থন জানানোর অনুরোধ করা হলেও তারা সেটি না করে বিরোধিতা করেছেন। সরকার পতনের পরে উল্টো জুলহাস স্যারের ভিসি হওয়া আমাদের অবাকই করেছে।
বুটেক্স সূত্র জানিয়েছে, টেক্সটাইল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয়কৃত মালপত্র বুঝে নেওয়া কমিটির (এক্সেপটেন্স কমিটি) আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক জুলহাস। এই পদে তিনি সরকার পতনের আগ পর্যন্ত ছিলেন। এ সময়ে কোনো টেক্সটাইল মেশিনারি তিনি টাকা ছাড়া ছাড়পত্র দেননি বলে অভিযোগ করেছিলেন একাধিক ঠিকাদার। বুটেক্সের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল কাশেমও অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, তার (অধ্যাপক জুলহাস উদ্দিন) বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের কিছু মৌখিক অভিযোগ এসেছিল। তবে কখনো লিখিত অভিযোগ পাইনি।
সূত্র আরও জানিয়েছে, টেক্সটাইল কলেজ থাকাকালীন ২০০৭ সালে টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেন্সি সার্ভিস ফির সাড়ে ৯ লাখ টাকা ব্যাংকে না রেখে ব্যক্তিগত ক্যাবিনেটে রেখেছিলেন এবং সেখান থেকে তা চুরি হয়ে যাওয়ার গল্প সাজিয়েছিলেন অধ্যাপক জুলহাস উদ্দিন। অবশ্য ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ আহমেদ কলেজের অধ্যক্ষ হলে সেই টাকা ফেরত দিতে তার ওপর চাপ দিতে থাকেন। পরে তিনি তার অ্যাকাউন্ট থেকে সেই টাকা ফেরত দেন।
বুটেক্স থেকে জানা গেছে, উপাচার্য হওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিয়েছেন অধ্যাপক জুলহাস। কিন্তু এখান থেকে আয়ের ২৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা দেননি। এ ছাড়া, নিজ বিভাগ ওয়েস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহকারী অধ্যাপক ও বুটেক্স শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাকিরুল ইসলাম পিয়াসের নিয়োগের ক্ষেত্রেও তার যোগসূত্র ছিল। যে কারণে ব্যাচের শেষের দিক থেকে দ্বিতীয় হয়েও যোগ্য অনেক প্রার্থীকে পেছনে ফেলে পিয়াস শিক্ষক হয়েছেন।
তিনি ডিন থাকা অবস্থায় পিয়ন জোবায়েরকেও কৌশল করে পদোন্নতি দিয়েছেন। এই পিয়নের বিরুদ্ধে কাজকর্মে ফাঁকিবাজি ও অনিয়মের অভিযোগ থাকায় আগের ডিনরা তাকে পদোন্নতি দেননি। অধ্যাপক জুলহাস ডিন হয়ে সেই পিয়নকে পদোন্নতি দিতে এক বছর অন্য সবার পদোন্নতিও বন্ধ রাখেন। এক বছর পর সেই জোবায়েরকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে অন্য সবার সঙ্গে পদোন্নতি দেন। নিজের গাড়িচালক হারুনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিআরটিএর পরীক্ষায় সেই গাড়িচালক ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে যান। পরে তাকে আর নিয়োগ দিতে পারেননি।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় ও এডিবির অর্থায়নে বুটেক্সে স্কিলস ফর ইন্ডাস্ট্রি কম্পিটিটিভনেস অ্যান্ড ইনোভেশন প্রোগ্রাম (সিসিপ) নামে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। গত তিন বছর ধরে এর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ছিলেন অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন। সম্প্রতি উপাচার্য হয়েই অধ্যাপক জুলহাস তাকে সরিয়ে ঘনিষ্ঠ মশিউর রহমানকে পিডি এবং মমিনুল হককে উপপ্রকল্প পরিচালক করেন। ডিপিপিতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পিডি নিয়োগের কথা বলা হলেও এক্ষেত্রে কনিষ্ঠ একজনকে পিডি করা হয়েছে।
বুটেক্স সূত্র জানিয়েছে, অধ্যাপক জুলহাস উদ্দিনের বিশ্বস্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির উপরেজিস্ট্রার মুহম্মদ শরীফুর রহমান ও সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) হোসাইন মুহাম্মদ আকবর। তাদের দুজনের স্ত্রীসহ একাধিক আত্মীয় বুটেক্সে কর্মরত। এর মধ্যে শরীফের স্ত্রী শারমিন আক্তারকে প্রথমে অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তাকে সহকারী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই পদের জন্য তার প্রত্যাশিত যোগ্যতা ছিল না। অন্যদিকে আকবর টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় কেনাকাটায় অনিয়ম করে মালপত্র বুঝিয়ে না দিয়ে চলে আসায় ওই বিশ্ববিদ্যালয় এখনো তাকে ছাড়পত্র দেয়নি। পূর্বের কর্মস্থল থেকে ছাড়পত্র আনতে না পারায় বুটেক্সে তার বর্তমান পদের চাকুরি এখনো স্থায়ী হয়নি। বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের পর সেসব ধামাচাপা দেওয়া হয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মো. জুলহাস উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। সে কারণে আমার নাম প্যানেলে ছিল। কাকে উপাচার্য বানানো হবে, সেটি সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে দুজন আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর ডিও লেটার পাঠানোর বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি তার। তিনি বলেন, এমনটি কখনো হয়নি।