মৌলভীবাজারের লাঠিটিলা বনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল পরিবেশ মন্ত্রণালয়। যদিও লাঠিটিলা বনটি সংরক্ষিত হওয়ায় সেখানে সাফারি পার্ক স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন পরিবেশবাদীরা। কিন্তু তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে সাফারি পার্ক স্থাপনের জন্য নেওয়া প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে বহুল আলোচিত লাঠিটিলা বনে দেশের তৃতীয় সাফারি পার্ক স্থাপন প্রকল্পটি বাতিল হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনুমোদিত প্রকল্পটি বাতিলের কার্যক্রম শুরু করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
গত বছর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ভেঙে পাহাড় ও গাছ কেটে তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নিজের নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজারের লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পে লাঠিটিলা বনের ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গাজুড়ে এই সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। পরিবেশ আইন না মানা, বাড়তি ব্যয়সহ নানা অসংগতির প্রকল্প প্রস্তাবে বনের ভেতরে হেলিপ্যাড নির্মাণের পরিকল্পনাও করা হয়।
পরিবেশবাদীদের দাবি ছিল, বনের মধ্যে এ ধরনের সাফারি পার্ক নির্মিত হলে তা হবে প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য আত্মঘাতী ও সর্বনাশা প্রকল্প। বন ধ্বংসের এমন উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিলেরও দাবি জানিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় সরকার। গত বছরের নভেম্বরে দেশের তৃতীয় সাফারি পার্ক স্থাপনের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। লাঠিটিলা বনের ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে খরচ ধরা হয় ৩৬৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেয় পরিকল্পনা কমিশন। সাফারি পার্ক অনুমোদনের বিষয়ে তখন পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের বিপদাপন্ন ও বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে। তবে প্রকল্পের আওতায় প্রকল্পভুক্ত জমিতে কোনো গাছ ও পাহাড় কাটা যাবে না—এ শর্তে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কয়েকটি খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে।
সে সময় পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হক কালবেলাকে বলেছিলেন, এটা সংরক্ষিত বন। সাফারি পার্ক স্থাপন করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না। একই সঙ্গে বনের ভেতরে পিচের রাস্তা করা যাবে না। এ কারণে গাছ এবং পাহাড় না কাটার শর্তে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে সরকার পরিবর্তনের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার। এজন্য গঠন করা হয় চার সদস্যের একটি কমিটি। সংরক্ষিত লাঠিটিলা অভয়ারণ্যে সাফারি পার্ক নির্মাণে বনাঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এমন কথা উল্লেখ করে প্রকল্পটি বাতিলের সুপারিশ করেছে যাচাই কমিটি।
পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের জন্য গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাঠিটিলা বন ইন্দো-মিয়ানমার জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ এবং এটি একটি হাতি করিডোর। এখানে সাফারি পার্ক নির্মাণ বনাঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বনের জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রস্তাবিত সাফারি পার্কের ফলে সৃষ্ট প্রভাবগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে এবং স্থানীয় অংশীজনের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে কমিটি মনে করছে, এ প্রাকৃতিক বনে সাফারি পার্ক নির্মাণ করা উচিত নয়। তাই প্রকল্পটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লাঠিটিলায় সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন বাতিলের সুপারিশ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অনুমোদিত প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উদ্যোগী মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বাতিলের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনের একনেক শাখায় পাঠানো হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, শর্তসাপেক্ষে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। শর্ত প্রতিপালন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করে পুনর্গঠন করে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এখনো পুনর্গঠিত ডিপিপি পাওয়া যায়নি। এ কারণে গত বছরের নভেম্বরে প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হলেও সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়নি। এ অবস্থায় উদ্যোগী মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। সে অনুযায়ী প্রকল্প বাতিলের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
লাঠিটিলা বনভূমিতে সাফারি পার্ক স্থাপনের যৌক্তিকতা হিসেবে প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়, বনাঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য হুমকির মুখে। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে পর্যটনকে উৎসাহিত করা, জবরদখল রোধ, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর বংশবৃদ্ধি, আহত ও উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণীর চিকিৎসা প্রদানের জন্য সাফারি পার্ক গড়ে তোলার জন্য আলোচ্য প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনভূমি এক সময় জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। লাঠিটিলা বিটের চিরসবুজ বনাঞ্চলকে ১৯২০ সালে পাথারিয়া হিল রেঞ্জের আওতাভুক্ত করে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়।