দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, এরপর সরকার পতনসহ নানা ইস্যুতে কয়েক মাস ধরে ভালো নেই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। কমেছে পণ্যের চাহিদা, কমেছে সরবরাহও। এ ছাড়া বৈশ্বিক সংকট ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় তলানিতে নেমেছে পণ্য বিক্রি। ভারী শিল্প সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল, পাথর, কয়লা আমদানির শীর্ষে থাকলেও বর্তমান সংকটে সেটিও কমেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে কমেছে কার্গো বা খোলা পণ্যের হ্যান্ডলিং। শিপিং এজেন্টরা বলছেন, ব্যাংকে তারল্য সংকট ও পাওনা পরিশোধ না করায় সহজে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না তারাও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ আগস্টের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে সব অবকাঠামোর নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। বিগত সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগ কাজ এখনো চালু হয়নি। অনেক ঠিকাদার লাপাত্তা। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অনেকেই আধিপত্য হারিয়ে নির্মাণাধীন কিংবা নির্মাণ পরিকল্পনায় থাকা ব্যক্তিগত-বাণিজ্যিক অবকাঠামো এগিয়ে নিচ্ছেন না, সরকারি মেগা প্রকল্পগুলোর কাজও চলছে সীমিত পরিসরে, হচ্ছে না গ্রামীণ অবকাঠামো, সিটি করপোরেশন এলাকায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ও সংস্কার। এসব কারণে ইস্পাত ও সিমেন্ট খাতের উৎপাদন ও বিক্রির অবস্থা খুবই নাজুক।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর বছরে প্রায় ১৩ কোটি টন কার্গো বা খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং করে। ভারী শিল্প সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল সিমেন্ট ক্লিংকার, রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপসহ পাথর, কয়লা থাকে আমদানির শীর্ষে। তবে গত কয়েক মাসে চিত্র পাল্টেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিক্রি কমে যাওয়ায় আমদানি কমিয়েছেন শিল্পমালিকরা। একই চিত্র আবাসন খাতেও। রড-সিমেন্টের বিক্রি কমে যাওয়ায় কমেছে উৎপাদন। এ অবস্থায় উৎকণ্ঠায় শিল্পমালিকরা।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিরুল হক কালবেলাকে বলেন, স্থানীয়ভাবে পণ্যের চাহিদা কমেছে। সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। রড বিক্রির অবস্থাও খারাপ। লোকাল ইন্ডাস্ট্রিজকে গুরুত্বের পাশাপাশি এক্সপোর্টকেও দিতে হবে। আমাদের প্লাস পয়েন্ট হলো, ডলারের যে অসামঞ্জস্যতা ছিল তা এখন সমাধান হয়েছে। তবে ইমপোর্টটা কমেছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে নাজুক ইস্পাত খাতের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তাই বাধ্য হচ্ছি উৎপাদন কমাতে। আমদানিও কমে গেছে। আশা করছি, পরিস্থিতির উন্নতি হবে, তখন আমদানিও বাড়বে।
এইচএম স্টিল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ সরোয়ার আলম বলেন, ইস্পাত কারখানার উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার মানে হচ্ছে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি। এরপরও সংকট কমে বাজার ভালো হবে, এমন আশায় প্রায় সবাই বাড়তি উৎপাদন করেছিল। এখন বিক্রি কমে কারখানা ও ওয়্যারহাউসে রডের স্তূপ জমেছে। বাধ্য হয়ে কারখানার মালিকরা প্রতিদিন তিন শিফটের পরিবর্তে এক বা দুই শিফটে উৎপাদন চালাচ্ছেন।
সিমেন্টের চাহিদা ২০-৩০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানান ডায়মন্ড সিমেন্টের পরিচালক হাকিম আলী।
শিপিং এজেন্টরা বলছেন, ভারী শিল্পের কাঁচামাল, গমসহ বেশ কিছু পণ্যের জাহাজ আসাও কমেছে। ব্যাংকে তারল্য সংকট ও বিক্রেতারা পাওনা পরিশোধ না করা পর্যন্ত পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ায় আমদানিকারকরা আগের মতো সহজে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে আমদানিতে।
আকিজ শিপিং লিমিটেডের মিজানুর রহমান বলেন, সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে কাজ করি। আগে প্রতি মাসে আট থেকে নয়টা জাহাজ আমদানি করতাম। এখন তিন বা চারটার বেশি করা যাচ্ছে না।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, নানা সংকটে কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমলেও বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আশা করি দ্রুত সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৩২৪ টিইইউস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক)। আর অক্টোবরে কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮৯ টিইইউস। এর আগে আগস্টে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২ লাখ ৭১ হাজার ৮৬৯ টিইইউস। জুলাইয়ে ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৩৫ টিইইউস, জুনে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭৭৩ টিইইউস ও মে মাসে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩ লাখ ১৯৩ টিইইউস। জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে ২৭ লাখ ১৭ হাজার ২১৪ টিইইউস।