শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছে। চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে তিন মাস ও ৯ মাসের সমন্বিত হিসাবে যে লোকসানে পড়েছে কোম্পানিটি, তা পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ ছাড়া কোম্পানিটির যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে, তা ফেরত দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এতে প্রায় মরতে বসেছে আর্থিক খাতের এই প্রতিষ্ঠানটি।
কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, লোকসানের মূল কারণ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। গত পাঁচ বছরে যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। এতে কোম্পানিটির মুনাফা করা দূরের কথা, উল্টো টিকে থাকতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে দিন দিন কোম্পানির লোকসানের পরিমাণও বাড়ছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে যেসব কোম্পানির খেলাপি ঋণের চিত্র বের হচ্ছে, তার অধিকাংশই হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কাগুজে কোম্পানিকে দেওয়া ঋণ। অথবা টাকা নেওয়া দরকার ছিল বলে ভুয়া নথি দেখিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে বড় অর্থ বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে করে কোম্পানিগুলো বাজারে টিকে থাকা বা ব্যবসা টিকিয়ে রাখার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এখানে সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ অবস্থায় পড়বে।
তথ্য অনুযায়ী, ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা শেয়ারবাজার থেকে তুলে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪১৮ কোটি ২৭ লাখ টাকায়। যেখানে কোম্পানিটি দিন দিন বড় লোকসান গুনছে, সেখানে এই কোম্পানিকে দেওয়া ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কোম্পানিটির বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে অধিকাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে কোম্পানিটির জন্য ব্যবসা টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে।
৮০ শতাংশ ঋণ খেলাপিতে: ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের কোম্পানি সচিব সাব্বিরুল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘এই লোকসানটা খুব স্বাভাবিক লোকসান। একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান চলে সুদের আয়ের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু কোম্পানির ব্যবসায়িক টাকা-পয়সা সব এখন ঋণখেলাপিদের হাতে। তারা ঋণের টাকা দেন না। আমরা আইনের আশ্রয় নিই। ঋণখেলাপিরা কেউ কেউ পলাতক, তাদের পাওয়া যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আয়ের (ইনকাম) যে টাকা, সব চলে গেছে খেলাপিদের হাতে। আমাদের তো কোনো আয় নেই। ২০১৭-১৮ সালের দিকে যে ঋণগুলো নিয়েছে, সেগুলো মূলত বেশিরভাগ খেলাপি হয়েছে। কোম্পানির খরচও দিন দিন বাড়ছে। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৮০ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।’
মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত—তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কতশত কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। এটা অ্যাকাউন্টস দেখে বলতে হবে। এই খেলাপি ঋণের জন্য প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী বাইরের ক্লায়েন্ট (গ্রাহক)।’
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খেলাপির যে মাত্রাটা বাড়ছে, এর মধ্যে একটা রাজনৈতিক যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন নিজস্ব উপায়ে পর্যাপ্ত সুশাসন নিশ্চিত করে ঋণ দেয়, তখন তারা গ্রাহকের সক্ষমতা ও বিভিন্ন কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই ঋণ দেয়। কিন্তু যখন কোনো ঋণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দেওয়া হয়, তখন এমন সব কোম্পানিকে ঋণ দেয়, যেগুলো কাগুজে। বাস্তবে দেখা যায় সেসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব নেই। যেমন আমরা দেখেছি, এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন গ্রুপ মিথ্যা কাগজ দেখিয়ে ঋণ নিয়ে গেছে। এমন ঋণ দেওয়া হলেই কোম্পানির লোকসানের পরিমাণ বাড়ে।’
তিনি বলেন, ‘এখন যারা দায়িত্বে আসছে, এগুলো তাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। যেসব টাকা চলে গেছে, সেগুলো শুধু পরিমাপ করা যাবে। এখন টাকা ফিরিয়ে আনার যদি কোনো স্কিম না করা হয়, তাহলে সেগুলো আনা এত দ্রুত সম্ভব নয়।’
খেলাপির হালনাগাদ তথ্য নেই: ফিনিক্স ফাইন্যান্সের বিতরণকৃত বা খেলাপি ঋণের কোনো হালনাগাদ তথ্য ওয়েবসাইটে দেওয়া নেই। তাই বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কী পরিমাণ ঋণ ও খেলাপি ঋণ আছে, তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে বিগত বছরগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাটির মোট বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬০৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বা ২২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর গত বছরের মার্চে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬৭ কোটি টাকা বা ৩৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তখনই উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
তখন বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল, যাচাই-বাছাই, ডিউ ডিলিজেন্স এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৪ ধারার নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে পর্যাপ্ত জামানত না নিয়েই ঋণ বিতরণ করা এবং ঋণ আদায়ে তদারকির অভাবের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভঙ্গুর কোম্পানির আর্থিক পরিস্থিতি: তথ্য অনুযায়ী, ফিনিক্স ফাইন্যান্স চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১৪ টাকা ২২ পয়সা। এ হিসাবে কোম্পানিটির তিন মাসে লোকসান হয়েছে ২৩৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। গত হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৯ টাকা ৬০ পয়সা বা ১৫৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
কোম্পানিটি ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সমন্বিত প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৪০ টাকা ৯৬ পয়সা। এ হিসাবে ৯ মাসে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ৬৭৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরে একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ২৩ টাকা ৭ পয়সা বা ৩৮২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির লোকসান দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ হিসাবে ১৬৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির নিট লোকসান হয়েছে ৬৭৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ঋণাত্মক হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির এনএভিপিএস দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৭৪ টাকা ২৫ পয়সায়। এমন অবস্থায় যদি কোম্পানিটি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয় তাহলে শেয়ারহোল্ডার থেকে শুরু করে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করা ঋণ দাতারাও তেমন কিছু আদায় করতে পারবে না।
কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ২০২২ সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। আলোচিত সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় হয়েছে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা। শেয়ারপ্রতি এনএভিপিএস দাঁড়ায় ৯ টাকা ১৮ পয়সা। এ ছাড়া আলোচিত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থপ্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হয় ঋণাত্মক ১ টাকা ১৪ পয়সা।
২০২১ সালের সমাপ্ত হিসাব বছরেও শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। আলোচিত হিসাব বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ২ টাকা ১১ পয়সা। এনএভিপিএস দাঁড়ায় ১৭ টাকা ৫৪ পয়সা। এর আগে ২০২০ সালের সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ৬ শতাংশ নগদ ও ৬ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। আলোচিত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় এক টাকা ৩৬ পয়সা। আর ৩১ ডিসেম্বর শেয়ারপ্রতি এনএভিপিএস দাঁড়ায় ২২ টাকা ১ পয়সা। এর আগের বছরও কোম্পানিটি ৬ শতাংশ নগদ ও ৬ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা দিয়েছিল। ওই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয় এক টাকা ৮৯ পয়সা। ২০১৯ হিসাব বছর শেষে শেয়ারপ্রতি এনএভিপিএস ছিল ২২ টাকা ৫০ পয়সা।
শেয়ারবাজারে কোম্পানির বর্তমান অবস্থান: কোম্পানিটি ২০০৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আর্থিক খাতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তখন কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। কোম্পানিটি ‘এ’ ক্যাটেগরিতে লেনদেন করলেও দীর্ঘদিন বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিএসইসির নির্দেশে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে পাঠায় ডিএসই।
৩০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের বিপরীতে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১৬৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। কোম্পানিটির রিজার্ভে ঘাটতি রয়েছে ২২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। কোম্পানির ১৬ কোটি ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার ১৯৫টি শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে ২৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৩ দশমিক ১৮ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকাদের কাছে রয়েছে ৪৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ শেয়ার। সবশেষ গত ৩১ অক্টোবর কোম্পানিটির শেয়ার ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ দর কমে লেনদেন হয়েছে ৫ টাকা ৩০ পয়সায়।