গত ৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা। অফিস শেষ করে ৩০০ ফিট রোড দিয়ে রিকশায় চড়ে নিজ বাসা কুড়িল যাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী নিশাত সাদিয়া। এ সময় হঠাৎ পেছন থেকে মোটরসাইকেলে এসে তার হাতে থাকা ব্যাগ টান দেয় ছিনতাইকারী। রিকশা থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়েন নিশাত। আর ছিনতাইকারীরা তার ব্যাগ নিয়ে মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। টাকা, মানিব্যাগ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হারিয়ে আহত অবস্থায়ই ভুক্তভোগী নিশাত খিলক্ষেত থানায় যান মামলা করতে। কিন্তু পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে চলে আসেন তিনি।
শুধু নিশাতই নন, রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন এলাকাতেই নিয়মিত ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন মানুষ। তাদের বেশির ভাগই ঝামেলা এড়াতে থানায় যান না। কেউ কেউ গেলেও ছিনতাই বা দস্যুতা মামলা না নিয়ে পুলিশ নিচ্ছে হারানো জিডি। শুধু আলোচিত ঘটনাগুলোতে নেওয়া হচ্ছে ছিনতাইয়ের মামলা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এই ধরনের সুস্পষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তা আমলে নিয়ে থানা পুলিশের ব্যবস্থা নিতে হবে, সে ধরনের নির্দেশনা দেওয়া আছে। ছিনতাইয়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে অবশ্যই সেভাবে মামলা নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, অনেক সময় কোনো এলাকায় অপরাধপ্রবণতা কম দেখাতে ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনাগুলোকে হারিয়ে যাওয়া হিসেবে থানায় নথিভুক্ত করার প্রবণতা দেখা যায়। এতে কিন্তু ওই অপরাধের প্রবণতাটাকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভুক্তভোগী কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেলে পুলিশের সঙ্গে জনগণের যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কটা আমরা চাচ্ছি, সেটা থেকে আরও দূরে সরে যাব।
অপরাধ কমাতে হলে পুলিশকে অবশ্যই প্রতিনিয়ত সক্রিয় থাকতে হবে উল্লেখ করে এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, ঘটনা যা ঘটে, সে বিষয়েই সুনির্দিষ্টভাবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অপরাধ ঠেকাতে আগাম ব্যবস্থা হিসেবে যেসব এলাকা বেশি অপরাধপ্রবণ, সেসব এলাকায় নজরদারি বাড়াতে হবে পুলিশকে।
ভুক্তভোগী নিশাত জানান, চলন্ত রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে তার মাথা ফেটে গেছে। হাত-পা কেটে গেছে। তিনি মামলা করতে চাইলেও নেয়নি পুলিশ। জিডি করলেও ঘটনার পর থেকে তার সঙ্গে থানা থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি।
নিশাত সাদিয়া যে এলাকাটিতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন, সেটি খিলক্ষেত থানা এলাকায় পড়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা না নিয়ে জিডি নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই থানার ওসি মুহাম্মদ আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই, ভুক্তভোগীর বিষয়ে আপনার জানা থাকলে থানায় পাঠাবেন। বিষয়টি অবশ্যই দেখব।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহবাগে ছিনতাইয়ের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অরিন্দম সাহা। রাত ১১টার দিকে আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে ফুটপাতে হুট করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত হাতে ছুরি নিয়ে ঘিরে ধরে তাকে। এরপর তার সঙ্গে থাকা মোবাইল এবং মানিব্যাগে থাকা প্রায় ৩ হাজার টাকা নিয়ে যায়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন অরিনন্দম। পুলিশ মামলা না নিয়ে তাকে জিডি করার পরামর্শ দেয়।
এর আগে ২৭ আগস্ট শাহবাগ থানা এলাকার পরীবাগে সন্ধ্যায় ছিনতাইয়ের শিকার হন নাজমুল হাসান সাগর নামে এক তরুণ। রিকশায় বসে মোবাইলে কথা বলার সময় পেছন থেকে দ্রুতগতির একটি বাইকে এসে ছিনতাইকারী ছোঁ মেরে নিয়ে যায় মোবাইল। ওই ঘটনায় তিনি শাহবাগ থানায় ছিনতাইয়ের অভিযোগ দিতে গেলেও পুলিশের পক্ষ থেকে মোবাইল হারানোর জিডি নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে পুলিশের রমনা জোনের এডিসি জুয়েল রানা জানান, তিনি ওই এলাকায় দায়িত্ব নিয়েছেন গত অক্টোবরে। এর আগে কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে তিনি অবগত নন। এখন এমন ঘটনা ঘটলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোহাম্মদপুরের বছিলার বাসিন্দা খন্দকার রাফি জানান, ১৯ অক্টোবর বিকেলে তার তিন স্বজন ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। ঘটনাটি জানিয়ে তিনি থানায় মামলা করতে চান; কিন্তু পুলিশ নেয়নি।
নিজেদের দুর্দশার কথা জানিয়ে নিশাত, অরিন্দম ও খন্দকার রাফি বক্তব্য দিলেও তাদের মতো কয়েক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করে জানান, তাদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন ঘটনা। ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নিতে অনীহা দেখায়। বিভিন্ন ঝামেলা ও হয়রানির কথা বললে তারা জিডি করে চলে আসেন।
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, কোনো এলাকায় ছিনতাই কিংবা ডাকাতির মামলা বেড়ে গেলে সেই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। সেক্ষেত্রে ওই থানার পুলিশ কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতনদের চাপে থাকেন। এজন্য অনেক থানার পুলিশ মামলা না নিয়ে শুধু জিডি নেন। ভুক্তভোগীও মামলার পর সাক্ষ্যসহ নানা দৌড়ঝাঁপের কারণে জিডিই করতে চান।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন মাসে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ৪৪টি এবং ডাকাতির ১৩টি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাস্তবে ঘটনার সংখ্যা অনেক বেশি। গত ৩ মাসে শুধু ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকাতেই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। এ ছাড়া হাজারীবাগ, নিউমার্কেট, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, মিরপুর, হাতিরঝিল, সবুজবাগ এবং মুগদায় বেশকিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
ডিএমপির পরিসংখ্যান বলছে, জানুয়ারিতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ২৫টি মামলা হয়। ফেব্রুয়ারিতে ২৬, মার্চে ২৮, এপ্রিলে ১৫, মে মাসে ১৯, জুনে ১৬, জুলাইয়ে ১৫ ও আগস্টে মাত্র চারটি ছিনতাইয়ের মামলা হয়।
ডিএমপির পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশি তৎপরতা কমে এলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। তখন থানাগুলোর কার্যক্রম ছিল কম বা কোথাও কোথাও পুলিশি কার্যক্রম ছিল না। তখন অনেক ঘটনাই নথিভুক্ত করা যায়নি। ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও অনেকেই মামলা করতে থানায় আসেনি। এজন্য প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে মামলার পরিসংখ্যানের তফাত থাকতে পারে। ফৌজদারি ঘটনায় ভুক্তভোগী চাইলে যে কোনো সময়েই থানায় এসে মামলা করতে পারেন।