বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন আবরার ফাহাদ। ২০১৯ সালে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়টির শেরেবাংলা হলে তাকে রাতভর নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন। গতকাল ৭ অক্টোবর ছিল তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজধানীর শাহবাগসহ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্মরণসভা, আলোচনা সভা, দোয়াসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন আবরার ফাহাদ।
একই সঙ্গে উচ্চ আদালতে দ্রুত বিচার শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। আবরার হত্যা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে গতকাল তিনি বলেন, আপিলের পেপার বুক প্রস্তুত করে দ্রুত হাইকোর্টে শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবকাশকালীন ছুটি শেষেই মামলাটির আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
গতকাল আবরারের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে স্মরণসভার আয়োজন করে কর্তৃপক্ষ। সভায় বক্তব্য দেন উপাচার্য অধ্যাপক আবু বোরহান মোহাম্মদ বদরুজ্জামান। আবরার ফাহাদকে রক্ষা করতে না পারায় তার বাবার কাছে বুয়েটের পক্ষ থেকে ক্ষমা চান তিনি। বলেন, আপনার ছেলে আমাদের কাছে দিয়েছিলেন; কিন্তু আমরা তাকে রক্ষা করতে পারিনি, এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার একটাই চাওয়া, এই প্রতিষ্ঠান থেকে আবরারের মতো আরও অসংখ্য বলিষ্ঠ, সত্যবাদী ও সাহসী ছাত্র যেন গড়ে ওঠে।
আবরারের বাবা বুয়েট প্রশাসনের কাছে দুটি দাবি জানান। তা হচ্ছে, ৭ অক্টোবরকে ‘শহীদ আবরার ফাহাদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা এবং বুয়েট সেন্ট্রাল লাইব্রেরির ‘শহীদ আবরার ফাহাদ লাইব্রেরি’ নামকরণ করা। শোকসভার পর শেরেবাংলা হলে শহীদ আবরার ফাহাদের স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্বোধন করা হয়।
এদিকে, আবরার ফাহাদ স্মরণে রাজধানীর পলাশীতে আয়োজিত স্মরণসভার পর ‘আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ’ পুনর্নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদ। স্মরণসভায় আবরার ফাহাদ হত্যার দিনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আগ্রাসনবিরোধী দিবস’ ঘোষণার দাবি জানান সংসদের আহ্বায়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, আবরার ফাহাদ একক কোনো ব্যক্তি নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক।
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৫৪ বছরের সংগ্রামে শহীদ আবরার ফাহাদ টার্নিং পয়েন্ট। আবরার ফাহাদ এই শতাব্দীর শহীদ তিতুমীর।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, গত পনেরো বছরে যেই সংবিধান আমাদের ওপর চেপে বসেছিল, যে সংবিধান আবরার ফাহাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী, যে সংবিধান জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শত শত শহীদ হওয়ার জন্য দায়ী, সেই সংবিধান এখনো বাংলাদেশ রাষ্ট্রে কীভাবে বিরাজমান? আমলারা জয় বাংলার স্টেটমেন্ট দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা চাই, এই সংবিধান অবিলম্বে বাতিল হোক।
এদিকে শাহবাগে আয়োজিত সংহতি সমাবেশ থেকে আবরারকে হত্যার দিনটিকে ‘জাতীয় নিপীড়নবিরোধী দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি জানিয়েছে নিরাপদ বাংলাদেশ চাই নামক সংগঠন। এই দাবির পক্ষে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ১১৮ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সংহতি বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
সংহতি সমাবেশে আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ বলেন, আমার সন্তানকে রাতভর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়েছে। আবরারের মতো আর কেউ যাতে এ নির্যাতনের শিকার না হয়, সেজন্য সবাইকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অনুরোধ করছি। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
ঢাবি ছাত্রশিবিরের আলোচনা ও দোয়া: এদিন সকালে হাতিরপুলে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার কার্যালয়ে শহীদ আবরার ফাহাদ স্মরণে ‘ফর ফ্রিডম অ্যান্ড ডিগনিটি: দ্য লিগ্যাসি অব আবরার ফাহাদ লিভস অন’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল আয়োজন করে সংগঠনটি। ঢাবি সভাপতি সাদিক কায়েমের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম।
মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলায় শিবির ট্যাগ দিয়ে ফ্যাসিবাদের সন্ত্রাসী বাহিনী ছাত্রলীগ কর্তৃক রাতভর নির্যাতনে শহীদ হন আবরার ফাহাদ। ধারাবাহিক অনেক ঘটনার মধ্য দিয়েই জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এর অন্যতম নায়ক শহীদ আবরার ফাহাদ।
ঢাবি শাখা সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যার দায় কেবল ওই ঘাতক দলেরই না, এই দায় তাদেরও যারা ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত থাকলেই নিপীড়ন করাকে বৈধতা দিয়েছিল।
ঢাবি ছাত্রদলের মৌন মিছিল: গতকাল দুপুর ১টায় আবরার ফাহাদের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘নিরাপদ ও মুক্তবুদ্ধি চর্চা’র গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাসের দাবিতে মৌন মিছিল করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এই মৌন মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে কার্জন হল ও দোয়েল চত্বর হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট প্রদক্ষিণ করে।
আবরারের কবর জিয়ারত ইনকিলাব মঞ্চের: আবরার হত্যাকাণ্ডের দিনকে ‘জাতীয় আগ্রাসনবিরোধী দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিভিত্তিক সংগঠন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে আবরারের কবর জিয়ারতের পর এ দাবি জানায় সংগঠনটি।