আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন দপ্তরে আসতে শুরু করেছে পরিবর্তন। এরই ধারাবাহিকতায় রেলওয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চলছে রদবদল। তবে একের পর এক বদলিকাণ্ডের পরও সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না রেল অঙ্গনে। গত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী বা বিতর্কিত কিছু কর্মকর্তা বহাল রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে। কোনো কোনো কর্তার বদলির আদেশ হলেও নানা অজুহাত বা তদবির করছেন সেই বদলি ঠেকাতে। আবার কেউ কেউ টানা ১৭ থেকে ২০ বছর ঘুরেফিরে ‘সংসার বেঁধেছেন’ রেল ভবনে। এদিকে বঞ্চিত কর্মচারীরা ‘বৈষম্যবিরোধী রেলওয়ে ফোরাম’ ব্যানারে তাদের ১৩ দফা দাবি তুলে ধরেছেন।
একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কালবেলাকে বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত করলে দুর্নীতি ও অনিয়মের অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। রেলের অনেকের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত চলছে। তাদের মধ্যে জেডিজি (উন্নয়ন-রোলিং স্টক) মো. সাদরুল হকসহ এমন অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন। এদের অনেককেই নামমাত্র বদলি করা হচ্ছে। বদলি কোনো শাস্তি নয়। রেলওয়েতে দুর্নীতি রুখতে হলে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা আরও বলেন, রেলে দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এর প্রতিটি সেক্টরেই চলছে অনিয়ম এবং ক্ষমতার দাপট। কেউ কেউ দীর্ঘবছর ধরে রয়েছেন শীর্ষ পদে। তাদের চিহ্নিত করে অন্যত্র বদলি এবং বিতর্কিতদের প্রত্যাহার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা।
রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার শাহাদাত আলী কালবেলাকে বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তাদের জিরো টলারেন্স রয়েছে। তার পরও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তা ছাড়া নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্প্রতি কিছু রদবদল হয়েছে। আশা করি নিয়ম মেনেই নতুন কর্মস্থলে কর্মকর্তারা যোগদান করবেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ সেপ্টেম্বর পৃথক পাঁচটি প্রজ্ঞাপনে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় রদবদল হয়েছে। এতে ঢাকা বিভাগের ডিআরএম শফিকুর রহমানকে চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) হিসেবে পদায়ন করা হয়। তবে প্রজ্ঞাপনের প্রায় ১৫ দিন পার হলেও শফিকুর রহমান দায়িত্ব নেননি। শফিকুর রহমান আওয়ামী লীগের টানা মেয়াদকালে প্রভাব খাটিয়েছেন রেল অঙ্গনে। ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি তার পক্ষে সাফাই গেয়ে তৎকালীন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের কাছে চিঠি লিখেন নরসিংদী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মো. নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। ওই চিঠিতে শফিকুর রহমানকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য উল্লেখ করে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিগত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার পরিবারের সক্রিয় ভূমিকার কারণে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়’ এমন কথাও লেখা রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে রেলওয়েতে বদলি হাওয়া শুরু হতেই শ্রমিক দলের নেতাদের নাম ভাঙিয়ে বদলি ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন শফিকুর রহমান।
বিতর্কের শেষ নেই এই রেলের আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা মেকানিক্যাল বিভাগের জেডিজি (উন্নয়ন-রোলিং স্টক) মো. সাদরুল হকের। তিনি ২০০৭ সালে রেলে যোগ দিয়ে সেই থেকেই রেলভবনে ঘুরেফিরেই দাপটের সঙ্গে বিভিন্ন পদে রয়েছেন। রেল ভবনে ‘নেগেটিভ’ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত এই সদরুল হক। গত ২২ সেপ্টেম্বর তাকে নামমাত্র বদলি করে সেই রেল ভবনেই অর্ডার করা হয়েছে। রেল ভবনেই ‘সব কিছুই তার’ এমন গুঞ্জন রয়েছে।
রেলওয়েতে ‘আওয়ামী-কানেকশন’ কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম তাবাসসুম বিনতে ইসলাম। যুগ্ম মহাপরিচালক (মেকানিক) এই কর্মকর্তা সিনিয়র অনেককে টপকিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেন। এই পদে আসার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। এ ছাড়া সাবেক একজন ডিজির আস্থাভাজনও ছিলেন তিনি। সেই ক্ষমতায় রেলের বদলি, পদোন্নতি থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজই ছিল নিজের নিয়ন্ত্রণে। তার বদলির অর্ডার হলেও এখনো যোগ দেননি পূর্বাঞ্চল অ্যাডিশনাল জিএম পদে। তাবাসসুম বিনতে ইসলাম গত আওয়ামী লী সরকারের আমলে ১৫ বছরে ৩৫ বারের বেশি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। সিনিয়র সব কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে ৩ নম্বর স্কেলও নেন তিনি।
একইভাবে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অ.দা.) এ এম মো সালাহ উদ্দিনকে ঘিরে নানা বিতর্ক রয়েছে। রেলওয়ে এই দাপুটে কর্মকর্তা সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশন (সিইসি) কাজি হাবিবুল আউয়ালের ভাগিনা হিসেবে পরিচিত রেল অঙ্গনে। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক সিইসি আউয়ালের (মামা) দাপট এবং ছাত্রজীবনে আওয়ামী লীগ নেতা আজম নাছির উদ্দিনের ছত্রছায়ায় দাপিয়ে চলেছিলেন তিনি।
আরও অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন রেল ভবন ও পূর্ব-পশ্চিমের রেল অঙ্গনে। বদলিকৃত অনেকেই নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি। তারা নানাভাবে বদলি ঠেকাতে মরিয়া।