সারা দেশে লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় বেসরকারি খাতের ছয়শ মেগাওয়াট ক্ষমতার ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ছয়টি কেন্দ্র বসিয়ে রেখেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ছয়টি কেন্দ্র চালানোর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত দেয়নি। যে কারণে এই কেন্দ্রগুলো চালু করা যাচ্ছে না। ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট (এনইএনপি)’ ভিত্তিতে কেন্দ্রগুলো চালানো গেলে বর্তমানে লোডশেডিং এক-তৃতীয়াংশ কমে আসবে। বর্তমানে দেশে দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। এই ছয়টি কেন্দ্র চালু হলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, এই ছয়টি ফার্নেস অয়েল প্লান্ট যদি এনইএনপির অধীনে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার অনুমোদন পায়, তাহলে তারা সরকারের কোনো তাৎক্ষণিক বিনিয়োগ ছাড়াই অন্তত এক-তৃতীয়াংশ লোডশেডিং কমাতে পারবে। পিক-লোড পাওয়ার প্লান্টগুলোর (সর্বোচ্চ চাহিদার সময় চালানো বিদ্যুৎকেন্দ্র) মধ্যে এই কেন্দ্রগুলো সাশ্রয়ী। কারণ এই কেন্দ্রগুলোর কোনো ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ নেই। ফলে কেন্দ্রগুলো সরকারের ওপরও আর্থিক চাপ তৈরি করবে না।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ডিজেল ও এলএনজিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চেয়ে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুৎ ৮ থেকে ১৫ শতাংশ কম দামের। এ ছাড়া কয়লা বা এলএনজিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালু করতে বেশি সময় প্রয়োজন হয় এবং ধীরে ধীরে লোড সমন্বয় করা হয়। কিন্তু ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো তাৎক্ষণিকভাবে চালু এবং বন্ধ করা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এই জাতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধারাবাহিকতাও প্রয়োজন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে বলেন, বিগত সময়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যবহারে বৈচিত্র্য এসেছে। যার ফলে অতিরিক্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, সব ভাড়া এবং দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান প্রত্যাহার করে এনইএনপি ব্যবস্থাটি বাস্তবায়ন করা উচিত।
একই কথা বলেন, বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সভাপতি ফয়সাল খান। তিনি ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে এনইএনপি প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ কেনার পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে পিডিবি শুধু উৎপাদিত বিদ্যুতের জন্য অর্থ প্রদান করবে। যেহেতু প্রাথমিক বিদ্যুৎ-ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) সময় প্রকল্পের মূলধন খরচ এবং ঋণ পরিশোধ করা হয়; তাই এখানে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার কোনো প্রয়োজনে নেই।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সারা দেশে তীব্র লোডশেডিং হচ্ছে, গ্রামীণ এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূলত প্রাথমিক জ্বালানি সংকট এবং রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থাগুলো দিয়ে জ্বালানি ক্রয়ের বিপরীতে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের কারণে দেশে আবার বিদ্যুতের লোডশেডিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বেশ কয়েকবার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছিল পেট্রোবাংলা।
অন্যদিকে, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাব করে বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি পড়ে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে অনেকখানি। ২০২৩ সালে কয়লা আমদানিতে বকেয়া টাকা পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায়। ওই সময় ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালিয়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা হয়। এই প্রেক্ষাপটে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো দ্রুত চালাতে সরকার অনুমোদন দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
পিডিবির সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি সত্ত্বেও সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের অবদান ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৫২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭২ শতাংশ ছিল। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবদান ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ শতাংশ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, ব্যয়বহুল ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার কয়েক বছর ধরে বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ২ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।