নানামুখী অনিয়মের কারণে সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ খাতের সংস্কারে এরই মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অতি-দুর্বল ব্যাংকগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর একীভূত করা হতে পারে বল ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক ছোট ও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের চিন্তা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও। সেক্ষেত্রে এই ধারার ব্যাংক ১০ থেকে কমে তিন-চারটিতে নেমে আসতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে শরিয়াহ নীতিমালা মেনে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে ১০ ব্যাংক। এর মধ্যে অন্তত সাতটি ভয়াবহ সংকটে আছে। মোটামুটি ভালো অবস্থানে রয়েছে মাত্র একটি ব্যাংক। শরিয়াহভিত্তিক এই ব্যাংকগুলো এখন ভয়াবহ তারল্য সংকটে রয়েছে। এমনকি অধিকাংশ ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ছোট ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার চিন্তা আছে। ব্যাংক সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারলে ভালো হবে। একীভূত করার ক্ষেত্রে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্যাংকগুলোকে যেহেতু মূলধন সহায়তা আমরাই করব, সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, অনেক ব্যাংকের আগের মালিকরা অনিয়মের কারণে মালিকানা হারিয়েছেন। এখন ওই ব্যাংকগুলো একীভূত করা সরকারের জন্য সহজ হবে। ব্যাংক একীভূত হলেও আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। এসব ছোট ব্যাংকের মধ্যে বেশিরভাগই ইসলামী ধারার ব্যাংক।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র বলছে, গঠিত টাস্কফোর্স ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ওপর পরিদর্শন পরিচালনার পর কোন কোন ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ বা একীভূত করতে হবে, তার বিষয়ে সুপারিশ করবে। এর পরই ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে নিঃসন্দেহে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের সংখ্যা কমবে বলেও নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পরিচালিত ব্যাংকটির চলতি হিসাবের ঘাটতি ৭ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ। ভয়াবহ তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকটি দেড় মাস ধরে গ্রাহকদের কোনো অর্থই ফেরত দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ তারল্যের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
খারাপ অবস্থা বিবেচনায় নিলে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ব্যাংকটির চলতি হিসাবে ঘাটতি ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। তারল্য ব্যবস্থাপনায় সংকটে থাকা এই ব্যাংকও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিশেষ তারল্যের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
ইউনিয়ন ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটি গত জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ২৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।
২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের বেশির ভাগই গেছে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব ঋণ এস আলম গ্রুপের বলেই জানিয়েছেন ব্যাংকটির ঋণ বিভাগের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে ইউনিয়ন ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানায়, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য, যা মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সেই প্রক্রিয়া থামিয়ে দেন। ঋণের টাকা আদায় না হওয়ায় ব্যাংকটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। এর পরও ব্যাংকটির লেনদেন নিয়মিত রয়েছে। এখন তা সীমিত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে ইসলামী ব্যাংকে। শুধু এস আলম গ্রুপই এ ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বের করে নিয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন গ্রুপকে ঋণ দিয়ে সেগুলো তুলতে না পারায় ব্যাংকটি এখন সংকটে পড়েছে। যদিও নতুন গভর্নর ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দেওয়ায় গ্রাহকদের আস্থা কিছুটা ফিরেছে। এজন্য আমানতে প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে।
গত জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ২০২ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটি তারল্য সহায়তার জন্য একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিলেও তার মূল্যায়ন করেনি সংস্থাটি। সম্প্রতি ব্যাংকটি ফের তারল্য সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক (সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংক)। ব্যাংকটি বর্তমানে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ মাত্র ৭৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৭৮ কোটি টাকাই খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৮৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। চলতি বছরের শুরু থেকেই ব্যাংকটি গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। বর্তমানে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা চেয়ে এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো আবেদন করেনি।
২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পায় গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় ব্যাংকটি বিভিন্ন দুর্বল ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানে ঋণ দিয়ে এখন ভয়াবহ তারল্য সংকটে পড়েছে। গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তারল্য সহায়তা স্কিমে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩২৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যদিও চলতি বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ ঋণ বিতরণের নীতিমালা পরিবর্তনের সম্ভবনা রয়েছে। এরপর আগামী ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পরিচালিত চলতি হিসাবেও ঘাটতিতে রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ৩৯ কোটি টাকা।
এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক থেকেও বেরিয়েছে বিভিন্ন অনিয়মের ঋণ। এখন পর্যন্ত ব্যাংক দুটিতে খুব বেশি সংকট তৈরি হয়নি। এখন পর্যন্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক।