অন্তু মুজাহিদ
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪২ এএম
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকারে সাহসী মায়ের ছেলে সানিয়াত

মানসিক রোগের ওষুধ খাওয়ায় পুলিশ

সানিয়াত ও তার মা শামীমা আক্তার লাকী। আদালত চত্বরের সেই ভাইরাল দৃশ্য (ডানে)। ছবি : কালবেলা
সানিয়াত ও তার মা শামীমা আক্তার লাকী। আদালত চত্বরের সেই ভাইরাল দৃশ্য (ডানে)। ছবি : কালবেলা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার আদালত চত্বরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, এক যুবককে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সেই মুহূর্তে তাকে পিঠ চাপড়ে সাহস দিচ্ছিলেন এক নারী। তাদের মধ্যে সামান্য কথাবার্তাও হয়। পরে জানা যায়, সে ঘটনার দুই চরিত্র মা ও ছেলে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর স্ত্রী-সন্তান। ছেলেটির নাম ওমর শরীফ মো. ইমরান। ডাকনাম সানিয়াত। আর মা শামীমা আক্তার লাকী। সাহসী মা-ছেলের মুখোমুখি হয়েছিল কালবেলা। দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে আসে সানিয়াতকে আটক থেকে শুরু করে সব ঘটনা। আদালত চত্বরে কী কথা হয়েছিল মা-ছেলের। তাও জানিয়েছেন তারা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অন্তু মুজাহিদ

সানিয়াত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যানেজমেন্টে স্নাতক এবং স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। এরপর আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে এমবিএ করেন। বর্তমানে তিনি বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অলিম্পিকে চিফ কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। ২০০৯ সালে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া সানিয়াত এখন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা নেপথ্য নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অন্যতম তিনি। এ কারণে গত ২৩ জুলাই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি পরিবারের। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় কারামুক্ত হন সানিয়াত। এর মাঝে ২৫ জুলাই আদালত চত্বরে ঘটে ছেলের পিঠ চাপড়ে মায়ের সাহস জোগানোর সেই আবেগঘন ঘটনা।

কালবেলা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আপনার সঙ্গে কী ঘটেছিল?

সানিয়াত: আমাকে তুলে নিয়ে যায় মূলত ২৩ জুলাই রাতে। আমার মা তখন হসপিটালে। বাবা বাসায় ছিলেন না। মেজো ভাইটা একটু ডাউনসিনট্রোম তো, হঠাৎ রাতের বেলা পেস্ট্রি খাবে বলে জেদ ধরেছিল। তো আমি বাধ্য হয়ে বসুন্ধরায় নর্থ-সাউথের পাশে একটি দোকানে ফোনে অর্ডার দিয়ে পেস্ট্রি নিতে যাই। দোকান থেকে বের হয়ে গাড়ির দরজা খোলার পর হঠাৎ করেই দেখি—অনেক গাড়ি এলো। সামনের গাড়ি থেকে নেমে একজন আমার পেছনে অস্ত্র ঠেকিয়ে বলল, নাম কি? নাম বলার পর ঘাড়টা ধরে একজন বলে, স্যার, এইটাই! এরপর টেনে নিয়ে আমাকে তাদের গাড়িতে উঠাল। পরে তারা বিভিন্ন জায়গায় ফোন করল। ওরা ওখানে আমাকে নিয়ে অনেকক্ষণ ছিল। আমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, আমার মা অসুস্থ। ফরাজি হাসপাতালে আছেন। বাবা কই, আমি বললাম আব্বাও ওখানে। বলে শিওর? বললাম, তিন দিন আগে কথা হয়েছে। তখন বলে, কেমন ছেলে যে তিন দিন আগে কথা হয়েছে? তখন বললাম, কেমন ছেলে ঠিক বলতে পারব না। তবে বাবা-মার কাছে আমি খুব ভালো ছেলে। কথা হয়েছে কী হয়নি, এটা বলে তো লাভ নেই। তখন বলে, কথাবার্তা ঠিকমতো কইরা বইল। তারেক রহমানের কোমর ভাঙছে দেখো নাই? তারপর আমি তার সঙ্গে আর কোনো কথা বলিনি।

পরে আমাকে নিয়ে গেল ফরাজি হাসপাতালে। নিচে আমাকে রেখে তারা ওপরে গেল। ১৫-২০ মিনিট পর দেখলাম যে, আমার সঙ্গে যারা ছিল তারা আর গাড়িতে উঠেনি। আরেক গ্রুপ আমার সঙ্গে উঠল। আমাকে ডিবি অফিসের দিকে নিয়ে গেল।

কালবেলা: আপনাকে আদালতে নেওয়ার সময়কার একটি দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, কী ঘটেছিল সেদিন?

সানিয়াত: সেদিন ছিল ২৫ জুলাই। দুপুর বেলা আমাকে কোর্টে নিয়ে আসা হয়েছিল। নামানোর পর গারদে রাখা হয়। গারদ থেকে যখন কোর্টে নিয়ে আসছিল তখন আমি একটু চুপচাপ ছিলাম। কারণ এর আগের দিন ওই যে কথাবার্তা বলছিলাম। তারা হাইপার করে, প্রতিউত্তর দিতে গেলে তারা মারে। তারা আমার কাঁধ, কান, চোয়াল সব জায়গায় মেরেছে। তো আমি একটা জিনিস জানতাম যে, মা হসপিটালে। আমি মনে মনে চাইছিলাম, আম্মা যেন না আসেন বা না দেখেন আমাকে। পেছন থেকে হঠাৎ করে আম্মা এলেন।

কালবেলা: আদালত চত্বরে মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?

সানিয়াত: আমি আম্মাকে দেখে সালাম দিলাম। সালাম দিতে গিয়ে আমার খেয়াল নেই যে, আমার হাত বাঁধা। হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো। হাত উঠিয়ে সালাম দিতে গিয়ে দুটি হাত উঠে গিয়েছে আমার। মা যখন বলছেন, ‘নো টেনশন।’ তখনই আমি যা পাওয়ার পেয়ে গেছি। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, যা শক্তি পাওয়ার ওই মুহূর্তে পেয়ে গেছি। ওই সময়টা ৮-১০ সেকেন্ডের বেশি হবে না। পরবর্তী রিমান্ড পর্যন্ত; কিন্তু ওটাই শেষ দেখা ছিল। আর দেখা হয়নি।

কালবেলা: কোর্টের ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে রিমান্ডে আপনার সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল?

সানিয়াত: ২৫ তারিখ থেকে মূলত তারা বলার চেষ্টা করছিল যে, তারেক রহমানের মতো আমারও কোমর ভেঙে দেওয়া হবে। রামপুরা থেকে শুরু করে সেতু ভবন বলেন, যা কিছু হয়েছে সব নাকি আমরা করেছি। উত্তর দিলেও মাইর, চুপ থাকলেও মাইর, চিৎকার করলেও মাইর, শরীর নাড়াচাড়া করলেও মাইর। নিয়মিত চলছে তো চলছেই। মারার সময় তারা দুজন দুজন করে মারে। আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ধরে মারে। দুজন যায় আবার দুজন আসে। তাদের ক্লান্তি আছে; কিন্তু আমাদের কোনো ক্লান্তি নেই। দুটি জিনিস তারা মেইনটেইন করত। এক শরীরের কোথাও দাগ পড়া যাবে না আর পানি খাওয়ানো যাবে না। এটা সবচেয়ে কড়া নিয়ম।

তৃতীয় দিনে এসে বলে আজ আপনাকে যা বাঁচাইতাম, বাঁচাইতে পারব না। আপনার মা যে আজ কোর্টে আসছে। আমি বললাম, আপনারাই তো জানেন যে আমার মা হাসপাতাল থেকে কোর্টে আসছে। বলে, এই ভিডিও করার কী দরকার ছিল? আমি বলি, কোন ভিডিও? তারা যেভাবে কথা বলে, মনে হয় ডুয়েল পার্সন সিনড্রোমের রোগী। সব যেন এক একটা অমানুষ। এই ভালো কথা বলছে, আবার ১০ মিনিট পর ওই আমাকে মারছে। আমি তো গলা বুঝতে পারছি, যে একই ব্যক্তি। বলে আপনাকে তো আর সেইফ করতে পারলাম না। স্যাররা সবাই খুব ক্ষিপ্ত। এই ভিডিও আপনার মাসহ। আমি বলি, ভাই, কোন ভিডিও? আসলে ভিডিও কোনটা আমি তো ভেতর থেকে কিছুই বুঝতে পারিনি। আমি চিন্তা করছি। ভিডিওটা কী তারা করল, নাকি নতুন কোনো কিছু আবার আনল? যেখানে একটু কথা বললেই মারে। এমনিতেই তারা যা করে, পরে আমি শুনেছি ওইদিন নাকি আমাকে ৯ জন মিলে মেরেছে। ওইদিন আমার সেন্স না থাকার মতো অবস্থা। সেন্স এলে বলে নাপা খাও। আমি বলি, কিছু খাইনি। বলে না, এই ওষুধ এমনিই খাওয়া যায়, নাপা। আমি বলছি, ভাই এখন খাব না। এরপর বকা দিয়ে চোখ বন্ধ করে জোর করে নাপা ওষুধ খাওয়ায়। পরে জেনেছি, এগুলো নাপাও ছিল না। ছিল সিজোফ্রেনিয়ার (মানসিক রোগ) ওষুধ!

রিমান্ডের চতুর্থ দিন আরও ১০ গুণের বেশি নির্যাতন করা হয়েছে। যখন নির্যাতন করত তার আগে চোখ বেঁধে নিত। এমনভাবে চোখ বাঁধত—মনে হতো চোখ দুটি বের হয়ে যাবে। জম টুপি পরানো থাকলে হাতে হ্যান্ডকাফ দেওয়া থাকত। আর চোখ গামছা দিয়ে বাঁধলে হাতও গামছা দিয়ে বাঁধা হতো। কারণ, তখন ওপরে ঝুলাত। প্রতিটি রিমান্ডে মারার দৃশ্য ভিডিও করে ডিবিপ্রধানকে দেখাতে হতো।

পঞ্চম দিন, সায়েন্সল্যাবে যখন আবার আন্দোলন শুরু হলো, সব শিক্ষার্থী আবার একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেখান থেকে ১৪ জনকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ওই ছেলেগুলো যখন দেখলাম, ডাক দিলাম। একজনের নাম আরাভ, অন্যজন সাফওয়ান। জিজ্ঞেস করলাম যে কী হয়েছে? বলে ভাইয়া, আপনার চেহারাটা খুব চেনা চেনা! একটা ভিডিও দেখেছি যেখানে আপনার চেহারার খুব মিল। ভিডিও শোনার পর এদিকে ভিডিও ভিডিও আওয়াজ উঠে গেছে। বলে, একজন মা পেছন থেকে সাহস দিচ্ছেন তার ছেলেকে। আপনারও তো কালো গেঞ্জি পরা। আমি বলছি, তাই নাকি? বলল, এটা আমাদের জন্য একটা অনুপ্রেরণা। এটা আমাদের জন্য উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করেছে। আমার মা তিন দিন ধরে আমাকে বের হতে দেয়নি। এই ভিডিও দেখার পর আমার মা তো আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। দুদিন পর বাবাসহ মা নিজেও রাস্তায় নেমে আসছে। অনেক ভালো লাগছে।

কালবেলা: পাঁচ আগস্ট ওই সময় কারাগারের অবস্থা কী ছিল?

সানিয়াত: পাঁচ আগস্ট আমাকে বোঝাতে দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। আমি আর আসিফ কেরানীগঞ্জ কারাগারের শাপলা-৪ এর এ-তে ছিলাম। ৩টার সময় আমাকে বলছে যে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। আমি সত্যি কথা বিলিভ করিনি। আমি বললাম, খবরদার কেউ গেট খুলবেন না। ডা. ডোনার আঙ্কেলসহ বিএনপির সিনিয়র নেতারা এসে বকা দেন। আমি বলেছি, আঙ্কেল তার পরও। উনারও আধা ঘণ্টা সময় লেগেছে আমাকে বুঝিয়েছে। মানে আসলেই যে উনি গেছেন। ৫ তারিখের পর জেলে অনেক রায়ট হয়। ৬ তারিখ সন্ধ্যায় বের হয় ওইদিন আমার মা দুপুর থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরে বের হয়ে আম্মাকে প্রথম দেখি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পারভেজ হত্যার ঘটনায় জবি ছাত্রদলের মশাল মিছিল 

দোতলা ভিসি ভবনে লিফট, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

ভারতের সহায়তা ছাড়া তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়

ডাক ও টেলিযোগাযোগ খাতের দুর্নীতি অনুসন্ধানে টাস্কফোর্স গঠন

মুগদা থানার ০৬নং ওয়ার্ডে ছাত্রদলের কর্মিসভা

দুদকের অনাপত্তিপত্র ছাড়াই থার্ড টার্মিনালের পিডি নিয়োগ

সাফল্যের ৭ বছরে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিউটি ই-কমার্স ‘চারদিকে’

সিরাজগঞ্জে ট্রিপল মার্ডারের আসামি রাজীবের মৃত্যুদণ্ড

মহিলা পরিষদের বিবৃতি / নারীকে আজ আর ঘরেও নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না

প্রকল্পের কাজ ঠিকাদার নয়, বাংলাদেশ বান্ধব হতে হবে : দুদক চেয়ারম্যান

১০

নরসিংদীতে ট্রেনের ধাক্কায় স্কুলছাত্রীর মৃত্যু

১১

এলজির উদ্যোগে ‘এলজি অ্যাম্বাসেডর চ্যালেঞ্জ ২০২৫’

১২

ওয়্যারড্রবে গুলি ও অস্ত্র রেখে দেন ইফতি, অতঃপর...

১৩

আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করলেন নুর

১৪

জামায়াতকে ‘ধর্ম ব্যবসায়ী-প্রতারক’ আখ্যা বিএনপি নেতা বাচ্চুর

১৫

খেলাফত মজলিস-এনসিপির সংলাপ, ৮ দফা ঐকমত্য

১৬

নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে আবেদনের সময় বাড়ল

১৭

৩০ হাজার তরুণকে নিয়োগ দিল ফিলিস্তিন যোদ্ধারা

১৮

ইস্টার সানডে উপলক্ষে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে প্রিন্সের শুভেচ্ছা বিনিময় 

১৯

বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কচ্ছপ খাচ্ছে গাজাবাসী

২০
X