ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। বৈধভাবে তার ভারতে থাকার মেয়াদ গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। কূটনৈতিক পাসপোর্ট অনুযায়ী বৈধভাবে তার ভারতে অবস্থানের মেয়াদ ছিল ৪৫ দিন। যদিও তার সেই পাসপোর্ট আগেই বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই পরিস্থিতিতে এখন হাসিনা কোথায় যাবেন বা কী করবেন, তা নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন—আজ থেকে শেখ হাসিনা কোন আইনের বলে ভারতে থাকবেন, না কি অন্য দেশে যাবেন। গত মঙ্গলবার জিনিউজের খবরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের বরাতে বলা হয়েছে, কূটনৈতিক পাসপোর্টের বদৌলতে শেখ হাসিনার ভারতে থাকার মেয়াদ শেষ হলেও তাকে বাংলাদেশে পাঠানোর সম্ভাবনা নেই। কোনো কোনো মহলের যুক্তি, হয়তো তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামার মতো ‘সাময়িকভাবে’ রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হতে পারে হাসিনাকে।
হাসিনাকে বিশেষ ভিসায় ভারতে অবস্থানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, না কি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে—এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে নয়াদিল্লি আজ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি।
হাসিনা দেশ ছাড়ার পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়, তাকে ভারত থেকে এনে তার বিচার করতে হবে। এরই মধ্যে ছাত্র-জনতা হত্যার অভিযোগে দুইশর বেশি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এখন ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে না চাইলে কী করবে বাংলাদেশ?
এদিকে হাসিনা ভারতে কোন স্ট্যাটাসে (শ্রেণি বা মর্যাদায়) রয়েছেন, সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের জানা নেই বলে গত মঙ্গলবার মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিমানে ভারতে চলে যান হাসিনা। এখন পর্যন্ত যতদূর জানা যাচ্ছে, দিল্লির উপকণ্ঠে একটি আধাসামরিক বাহিনীর অতিথিনিবাস বা ‘সেফ হাউসে’ই দুই বোনকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে তাদের ঠিকানা কী, সেটা সরকারিভাবে কখনোই প্রকাশ করা হয়নি।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তিও রয়েছে, যা ২০১৩ সালে হাসিনার নিজের সরকারের সময়েই স্বাক্ষরিত, যেটি তত্ত্বগতভাবে হাসিনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা যেতে পারে, যদি বাংলাদেশের নতুন সরকার তাকে গ্রেপ্তার করতে চায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, আমরা তাকে (হাসিনাকে) বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণের দাবি জানাতে পারি।’ হাসিনার উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করা বিতর্কিত মন্তব্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তাকে ফেরত না চাওয়া পর্যন্ত ভারত যদি তাকে রাখতে চায়, তাহলে শর্ত হবে, তাকে চুপ থাকতে হবে।’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলার পর যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে হস্তান্তরের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ জানায়, তখন নয়াদিল্লির আইনি উপায় কী হবে? এ নিয়ে ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসে এক নিবন্ধে ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুলের অধ্যাপক প্রভাষ রঞ্জন লিখেছেন, ভারতের প্রত্যর্পণ আইন-১৯৬২ ছাড়াও হাসিনার সরকারের সঙ্গে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিও বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ১৯৬২ সালের প্রত্যর্পণ আইনের ১২(২) ধারা ও ভারত-বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তির শর্তগুলোও হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশ ২০১৩ সালের চুক্তির ওপর নির্ভর করতে পারে। তবে অভিযুক্তদের প্রত্যর্পণ ত্বরান্বিত করার জন্য ২০১৬ সালে অপরাধের প্রমাণ শেয়ার করার প্রয়োজনীয়তা বাতিল করা হয়, যে কারণে বাংলাদেশ এ ধরনের অনুরোধ করলে হাসিনাকে হস্তান্তর করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে ভারতের।