দুরন্ত কিশোর সাদ মোহাম্মদ খান। সাভারের একটি মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ২০ জুলাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে নিউমার্কেটের চাপাইন রোডের সামনে জড়ো হয়। সেখানেই বিকেল সাড়ে ৫টার পর পুলিশের ছোড়া গুলি গিয়ে বাঁ পায়ের ঊরুতে লাগে ১৪ বছরের সাদের। গভীর ক্ষত নিয়ে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেদিনই সন্ধ্যা ৭টায় চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুমাস পেরোলেও শুকায়নি সাদের বাবা বাহাদুর খানের চোখের পানি। শেষ হয়নি দীর্ঘশ্বাস। আক্ষেপ করতে করতে কালবেলাকে বলেন, দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে সুখের সংসার ছিল। সাদ ছিল মেজো। মানুষের মতো মানুষ হওয়ার মাদ্রাসায় দিয়েছিলাম। সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল। ওর মা খাওয়া-নাওয়া ভুলে গেছে। ছেলের হত্যাকারীর বিচার চাই।
ঘটনাস্থল রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী। ১৮ জুলাইয়ের আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের নিজের টমটমে তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছিল ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সেও শরিক হয়েছিল। বনশ্রী ই-ব্লকে বড় মসজিদের সামনে ১৮ জুলাই একটি গুলি তার ডান চোখে ঢুকে খুলি দিয়ে বেরিয়ে যায়। আহতদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেই আলিঙ্গন করে মৃত্যুকে। ছাত্ররা তাকে নিকটস্থ ফরাজি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। স্থানীয় টমটম চালক হাবিব কালবেলাকে বলেন, ‘আমি নিজেই ওরে কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম। পরীক্ষা করে ডাক্তার বলে মারা গেছে।’
১৯ জুলাই ১০-১২ বছরের আরেক বালক রহিম মিছিলের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বিজিবির সাজোয়া যান নিয়ে বের হয়। সেই যান থেকে হঠাৎ গুলিবর্ষণ শুরু হয়। মাথার বাঁদিকে গুলি লেগে মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে। রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। শিক্ষার্থীরা তাকেও ফরাজী হাসপাতালে নেন। চিকিৎসকরা জানান ছেলেটি ততক্ষণে বেঁচে নেই।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রনি আহমেদ ছিলেন পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি জানান, ছেলেটির পেছনেই ছিলাম। ‘ও আল্লাহ’ বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটি গুলি আমার বাঁ পায়ের ঊরুতে লাগে। প্রাণটা বাঁচলেও এক মুহূর্তেই ৫ থেকে ৬ জনকে ঘটনাস্থলেই মারা যেতে দেখেছি।
ফরাজী হাসপাতালের ডেপুটি ম্যানেজার পিয়াল হাসান রুবেল কালবেলাকে বলেন, সে সময় নাম জিজ্ঞেস করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তাই হতাহতদের নাম রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর মুমূর্ষুদের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা বিনামূল্যেই দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিন বনশ্রীতে গিয়েও নিহত দুই কিশোরের স্বজনদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেউ বলতে পারেননি তাদের নাম বা পরিচয়, দিতে পারেননি পরিবারের ঠিকানাও। তবে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্যমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৮৩ শিশু। এর মধ্যে ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ১৫ বছরের নাসিমা এবং স্থানীয় কাদের মোল্লাহ হাইস্কুলের ছাত্র তাহমিদ ভূঁইয়া তামিম। পরদিন প্রাণ হারায় উত্তরার ১৫ বছরের নাঈমা সুলতানা, বনশ্রীর মাদ্রাসা ছাত্র আশিকুল ইসলাম (এলিস আশিক) এবং মিরপুরের কাফরুলের মাদ্রাসাছাত্র সৈকত সমীর। এ ছাড়া ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে ৪ বছরের আব্দুল আহাদ, নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের সাইনবোর্ডে ১০ বছরের হকার হোসেন মিয়া, রাজধানীর পান্থপথে ১৩ বছরের মোবারক হোসেন, নরসিংদী ইটাখোলার গ্যারাজ মিস্ত্রি ১৫ বছরের হৃদয় মীর এবং মাধবদীর ১৫ বছরের আশিক মিয়া নিহত হয়।
সরকার পতনের পরও হামলা-অগ্নিসংযোগে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কেউ বাসায়, কেউ ছাদে খেলার সময়, বাসা থেকে বিক্ষোভ দেখার সময়, আবার কেউ মা-বাবার সঙ্গে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে প্রাণ হারান।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সম্প্রতি কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় সারা দেশে কমপক্ষে ৭০ শিশু-কিশোর নিহত হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে শতাধিক। নিহতদের মধ্যে ৬০ জনের লাশে গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। অনেকের বিক্ষোভে অংশ নিয়ে, আবার অনেকের রাস্তা পার হওয়ার সময় গুলি লাগে। বাসায় থেকেও গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
ইউনিসেফের সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে থেকে জানা যায়, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে বাংলাদেশে ৬৫ জনের বেশি শিশু নিহত হয়েছে। হাসপাতালগুলোর তথ্যমতে, ৭৯ শিশু-কিশোরের শরীরে ছররা ও প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া স্থাপনা ও যানবাহনে দেওয়া আগুনে পুড়ে মুত্যু হয় ৯ জনের। একজনের মৃত্যু হয় সাউন্ড গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে।