প্রাথমিকের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি। কিশোর বয়সেই কাজ করেন পুলিশের সোর্স হিসেবে। তখন থেকেই জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। নব্বইয়ের দশকের ঘটনা এটি। ঢাকা সিটির তৎকালীন ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার হাজী জুম্মনের নেক নজরে পড়েন এক সময়। তার পর থেকেই তার উত্থান। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর আবদুল মান্নান। মাদকের গডফাদার হিসেবে এলাকায় পরিচিত তিনি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা মান্নানের নেতৃত্বে হয়নি।
ঢাকা মহানগর পণ্য পরিবহন এজেন্সি মালিক সমিতির নেতৃত্বেও রয়েছেন কাউন্সিলর মান্নান। এ কারণে পণ্যের আড়ালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় অবাধে মাদক পৌঁছে যেত। তার অপরাধলব্ধ আয়ের বড় একটি অংশ যেত পুলিশের পকেটে। পুলিশের সঙ্গে তার সখ্য থাকায় মাদকের কোনো চালান আটক হলেও ছেড়ে দিত পুলিশ। কৌশলী মান্নান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। এ কারণে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলীয় অন্য কাউন্সিলররা আত্মগোপনে চলে গেলেও মান্নান এলাকাতেই আছেন। অভিযোগ রয়েছে, তাকে শেল্টার দিচ্ছে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশ।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পতনের আগে বয়রাত মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে নাশকতার মামলায় আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে রাতে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আসামিকে ছাড়িয়ে নেন আবদুল মান্নান। এ ঘটনা জানাজানি হলে বংশাল থানার তৎকালীন ওসি মাইনুল হোসেনকে সেদিন রাতেই প্রত্যাহার করা হয়।
মান্নানের বিরুদ্ধে ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট মহানগর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। চাহিদা মতো টাকা না দিলেই তাদের বদলির হুমকি দিতেন। নিজেই লিখিত অভিযোগ করতেন মেয়রসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে।
দেশের বৃহত্তম বাদামতলী ফলের আড়তে আসা যানবাহনসহ এলাকার সব সড়কে যানবাহন পার্কিং, মালপত্র লোড-আনলোড ও সড়কে চাঁদাবাজি হতো এই কাউন্সিলরের নেতৃত্বে। সড়কে চাঁদাবাজির কারণে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনের সড়কসহ ২০টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হতো।
টিসিবির চাল বিতরণেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে কাউন্সিলর মান্নানের বিরুদ্ধে। নেশাগ্রস্ত হয়ে প্রায়ই হুমকি-ধমকি দেন সাধারণ মানুষকে। তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে তার ওপর চালানো হতো নির্যাতন। সম্প্রতি জিন্না হাজী (৭৪) নামে এক নিরীহ ব্যক্তিকে পুলিশ দিয়ে আটক করেন তিনি।
নিজের দলের নেতাকর্মীরাই তার বিরুদ্ধে নানা সময় নানা অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু কাউকেই পাত্তা দিতেন না কাউন্সিলর আবদুল মান্নান। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মুরাদ আহমেদ চৌধুরী পলক কালবেলাকে বলেন, তার (মান্নান) নানা অনিয়মে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। এলাকাবাসীকে নিয়ে আমরা মেয়রের (সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস) কাছে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও করেছিলাম। মেয়র কোনো ব্যবস্থা নেননি। মান্নানের অপকর্মের প্রতিকার চেয়ে এলাকায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও তখন পালিত হয়েছে। তার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
একই অভিযোগ কাউন্সিলরের দীর্ঘদিনের সহযোগী কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জাহাঙ্গীর সিকদারের। তিনিও কালবেলাকে বলেন, কাউন্সিলরের লোকজনের চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও জবরদখলের ফলে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ ছিল।
৩২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মোস্তাকীম বাদল বলেন, কাউন্সিলর আবদুল মান্নান দলীয় প্রভাব খাটিয়ে লাইসেন্স করা চাঁদাবাজে পরিণত হয়েছেন।
ওয়ার্ড আওয়ামী শ্রমিক লীগের সভাপতি আউলাদ হোসেন লাবু বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে মান্নান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অফিস ভেঙে ফেলেছে। টিসিবি পণ্য বিতরণ নিয়ে তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে।
বংশাল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইমরান হোসেন জন বলেন, মাদকমুক্ত ওয়ার্ড গড়ার ঘোষণা দিলেও কাউন্সিলরের পাশাপাশি তার ছেলে নাজমুস সাকিবও নেশা করেন। তার ছেলের নেশা সেবনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এলাকায় সিটি করপোরেশন কোনো দরপত্র আহ্বান করলে মান্নান কোনো ঠিকাদারকেই দরপত্র ক্রয় করতে দেননি। নিজেই দরপত্র কিনে নিজেদের লোক দিয়ে কাজ করাতেন।
অভিযোগের বিষয়ে কাউন্সিলর আবদুল মান্নান কালবেলাকে বলেন, ‘মান্নান কখনো কোনো অপরাধ করে না। মান্নানের এত ক্ষমতা নেই যে, চাইলেই মানুষ টাকা দেবে। আপনাকে আমার বিরুদ্ধে কেউ ভুল তথ্য দিয়েছে।’ এ কথা বলে তিনি লাইন কেটে দেন। এরপর আর তিনি ফোন ধরেননি।