ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কাওলা এলাকার বাসিন্দারা দিনে-রাতে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। সন্ধ্যার পরে কয়েল জ্বালানো বা স্প্রে প্রয়োগ ছাড়া বাসাবাড়িতে টেকা কষ্টকর। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে মশককর্মীর দেখা মিলছে না। ডেঙ্গুর ভরা মৌসুমে এ অবস্থায় আতঙ্কিত স্থানীয়রা। আজিজুল ইসলাম নামে এক বাসিন্দা জানান, স্থানীয় কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈম বিদেশ পালাতে গিয়ে আটক হয়েছেন। তার অনুগতরাই মশকনিধন কর্মী। কাউন্সিলরের অনুপস্থিতিতে মশকনিধন কর্মীরাও লাপাত্তা। এডিস মশা নামের দানবের কারণে এলাকাবাসীর
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই।
শুধু কাওলা নয়, গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় এডিস মশার লার্ভা নিধনের বিশেষ অভিযানে ভাটা পড়েছে। বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি পালিয়ে থাকায় মাঠ পর্যায়ে অনেকেই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। পাড়া, মহল্লা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলরের সমন্বয়ে নেই কোনো প্রচার কার্যক্রম। ডিএনসিসির চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক আর ডাবের খোসা কেনার কার্যক্রমও বন্ধ। মশা নিয়ন্ত্রণে ড্রোন, ব্যাঙ, হাঁস আর গাপ্পি মাছের ব্যবহারও নেই। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরকে এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় চিহ্নিত করা হয়। বর্ষার শেষ সময়ে এসে মাঝেমধ্যেই নামছে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির পানি জমে থাকায় প্রজননের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সবখানেই এখন মশার রাজত্ব। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, বর্তমানে মশা নিধনে সব কার্যক্রমই স্বাভাবিক রয়েছে।
মশক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা মারার নামে সিটি করপোরেশনে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। এই পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে আধুনিক পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। সিটি করপোরেশন যে কাজ করছে, তাতে খুব একটা মশা কমছে না। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার ঘনত্ব এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে গত বছরের চেয়ে এবার আরও ভয়ংকর চেহারায় দেখা যেতে পারে ডেঙ্গু।
চলতি বছর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ৮১৯ জন। মারা গেছেন ১০২ জন। এর মধ্যে ঢাকাতেই ৬৯ জন। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। কাউন্সিলররা আগে মশার ওষুধের চাহিদাপত্র দিতেন প্রয়োজন অনুযায়ী। কাউন্সিলররা আত্মগোপনে থাকায় সেটা দিতে পারছেন না। অনেক কাউন্সিলর কার্যালয়ে এখনও তালা ঝুলছে। মশককর্মীরা সেখান থেকে ওষুধ পাচ্ছেন না। আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ওষুধ সরবরাহ করা হলেও অতীতের মতো অসাধু মশককর্মীরা সেই ওষুধ কীটনাশকের দোকানে বিক্রি করে দিচ্ছেন। মশক নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহৃত ওষুধের পর্যাপ্ত মজুত নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। সিটি করপোরেশনগুলো নিজস্ব উদ্যোগে ওষুধ কেনার কার্যক্রম হাতে নিলেও এখন তা বন্ধ রয়েছে।
ডিএনসিসির প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ওষুধের সংকট নেই। পাঁচ মাসের ওষুধ জমা আছে। জলাশয়ে ব্যবহারের নোভালরুন ট্যাবলেটও আছে। আর ম্যালেরিয়া অয়েল তাৎক্ষণিকভাবে পদ্মা অয়েল কোম্পানি থেকে সংগ্রহ করা যায়।
তবে গত দুই মাসের মধ্যে কোনো জলাশয়ে নোভালরুন ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়েছে কি না তা ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের কেউ জানাতে পারেননি। একইভাবে দুই সিটির কোনো জলাশয়ের ঝোপঝাড়ও পরিষ্কার করা হয়নি। সকাল-সন্ধ্যা লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং করতেও মশককর্মীদের কালেভদ্রে দেখেছেন নগরবাসী। মশার ডিমপাড়ার মতো পাত্রগুলোও ধ্বংস করা হয়নি। বরং মশক প্রতিরোধে গত ১৭ জানুয়ারির আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, থানাগুলোতে আটক যানবাহনের মধ্যে যাতে পানি জমে মশার প্রজননস্থল তৈরি না হয়, সে কারণে ত্রিপল দিয়ে সেগুলো যেন ঢেকে রাখা হয়। ৫ আগস্ট ঘিরে থানা ভবন ও ভেতরে থাকা গাড়িগুলো পুড়িয়ে দেওয়ায় সেসব থানা কম্পাউন্ড পুরোটা এখন মশার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই লিফলেট বিতরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবককে এক সুতায় গেঁথে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান, মসজিদে নামাজের পর ইমামের সচেতনতামূলক বয়ান, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিটি করে সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, বিশিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে প্রচারণা, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানোসহ নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হতো। জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ার পর এসব কার্যক্রম গতি হারিয়েছে। সম্প্রচার মাধ্যমে দুয়েকবার প্রচারণা চালানো হলেও তা যৎসামান্য।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হলেও চলতি বছর এর আগেই এর দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে করপোরেশনগুলোর কাজের গতিতে অনেকটা স্থবিরতা এসেছে। এখনকার এডিস মশার ঘনত্ব থেকেই বোঝা যায়, গত দু-এক মাস মশক নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজই হয়নি। এখনো প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। তাই সেপ্টেম্বরের শেষে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা নিয়ে আমরা আতঙ্কিত। এখনই হটস্পট চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এবার ডেঙ্গু আরও বিপদে ফেলবে।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে এ বিষয়ক কার্যক্রম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি এ খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) খিলগাঁও এলাকার এই ময়লা-আবর্জনায় ভরা খালই এখন মশার আঁতুড়ঘর। এ ছাড়া বৃষ্টিতে বাসাবাড়ির ছাদ এবং রাস্তায় জমে থাকা পানিও বাড়াচ্ছে ডেঙ্গুর ঝুঁকি। মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড তিনটি ওয়ার্ডই এখন রোগীতে পরিপূর্ণ। মুগদা, মান্ডা, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ীসহ ডেঙ্গু উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকার রোগীই বেশি এখানে। জ্বর, মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণসহ নানা উপসর্গ নিয়ে এসেছেন অনেকেই। নাসরিন নামে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক নারী বলেন, আমি শনিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এ পর্যন্ত ৫টি স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকেই জ্বর নেই কিন্তু জ্বর যখন ওঠে দু-তিনজনও ধরে রাখতে পারে না। এ ছাড়াও সঙ্গে থাকে মাথা ব্যথা, বমি।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের তেমন গতি না থাকায় ডেঙ্গু বাড়ছে বলে অভিযোগ স্বজনদের। আসিফ আহমেদ নামে একজন জানান, সিটি করপোরেশনেরও কিছু গাফিলতি আছে। তারা ঠিকমতো স্প্রে করে না।
মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পরিচালক ডা. এস এম হাসিবুল ইসলাম বলেন, গত বছরের মতো এখনো অবস্থা খারাপ হয়নি। মুগদা হাসপাতালে গত বছর জুলাই মাসে রোগী ছিল ১৪ হাজার এবং সেপ্টেম্বরে ১১ হাজার। সে-তুলনায় আমি বলব এবারের অবস্থা ভালো। কিন্তু আস্তে আস্তে ডেঙ্গুর অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
সরেজমিন গুলশান, মহাখালী, মিরপুর ও শেওড়াপাড়া এলাকা ঘুরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব এলাকাতেও মশককর্মীরা সক্রিয় নন। কাউন্সিলরের অনুপস্থিতিতে ডিএনসিসি গত ২ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতায় ১০টি অঞ্চলে টিম গঠন করলেও সেই টিমের কার্যক্রম চোখে পড়েনি। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকায় নিয়মিত লার্ভিসাইডিং ও ফগিং কার্যক্রম এখন আর নেই।
গুলশানের বাসিন্দা আসাদুল ইসলাম বলেন, গত এক মাসে এ এলাকায় দুদিনও মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি। এ কয়েক দিনে মশার উৎপাতও বেড়েছে কয়েক গুণ। আশপাশে বেশ কয়েকটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। আগে মাঝেমধ্যেই এ ধরনের ভবনে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হতো। সেখানে ওষুধও ছিটানো হচ্ছে না।
ডিএনসিসির প্রশাসক মাহমুদুল হাসান কালবেলাকে বলেন, মশক নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। বেশ কয়েকটি তদারকি টিম গঠন করা হয়েছে। উত্তর সিটি এলাকায় গত বছরের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১০ ভাগের এক ভাগ। মাঝখানে হয়তো কিছুটা সময় মশক নিধন কার্যক্রমে সংকট হলেও এখন ছুটির দিনেও তা চলছে। কর্মীরা শিফট করে ফুলটাইম কাজ করছেন। নিয়মিত তদারকি অব্যাহত রয়েছে। আমরা আশা করছি, এ বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ থাকবে, আর বাড়বে না।
ডিএসসিসির প্রশাসক ড. মহা শের আলী বলেন, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে মশকবাহিত রোগ প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভা হয়েছে। সভায় উপদেষ্টা মশক নিধনে নির্দেশনা দিয়েছেন। সিটি করপোরেশন মশক নিধনে লার্ভিসাইডিং, ফগিংসহ অভিযান ও প্রচারণাকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কারও অনুপস্থিতিতে কোনো কাজ থেমে নেই।