থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতায় দেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে দেশে মশক নিধন কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, এডিস মশার ঘনত্ব অনুযায়ী চলতি সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার এক দিনে সবচেয়ে বেশি পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। এর আগের দিন সোমবার এক দিনে মৌসুমের সর্বোচ্চ ৬১৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অচলাবস্থার কারণে ডেঙ্গু সংক্রান্ত মৌসুম জরিপ করা সম্ভব হয়নি। এতে বর্তমানের ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেকটা অজানাই থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে স্বাভাবিক করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এক মাসেরও বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য খাতে অস্থিরতা চলছে। এই স্থবিরতার প্রভাব ডেঙ্গু মোকাবিলায়ও পড়ছে। অচলাবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বর্ষার সময় এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি জানতে রাজধানীতে জরিপ করাও সম্ভব হয়নি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ অচলাবস্থা কাটাতে হবে। যে কোনো মূল্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে কার্যকর করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এর পরও ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ হয়তো কঠিন হবে। কারণ সিটি করপোরেশন ও জেলা পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধনে ভয়ংকর প্রভাব পড়ছে। এজন্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিক লোক নিয়োগ করে হলেও শহরে ময়লা ও জমে থাকা পানি নিষ্কাশন ও মশার ওষুধ ছিটাতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক দশকে (২০১৪-২৩) সেপ্টেম্বর মাসে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর পিক সিজন হয়েছে পাঁচবার। অক্টোবরে তিনবার, আগস্ট ও নভেম্বরে একবার করে। কিন্তু এবার বর্ষা মৌসুমে লার্ভার উপস্থিতি জানতে কোনো জরিপ পরিচালনা করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় ধারণা করা হতো, বর্ষাকাল মানেই ডেঙ্গুর মৌসুম। কিন্তু এখন সেই ধারণা বদলে যাওয়ার সময় এসেছে। কারণ এখন শুধু বর্ষা নয়, শীত-গ্রীষ্মেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় বর্ষার আগে, বর্ষার সময় এবং বর্ষার পরে তিনবার এডিস মশার লার্ভার জরিপ করা হয়। এবার বর্ষার আগের জরিপ করা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতির কারণে এরপর আর জরিপ করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনাও নেই। তবে আগের জরিপ তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি সব হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট, আইভি ফ্লুইড স্যালাইন ও পর্যপ্ত ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। গণমাধ্যমে ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচারণা চালানো হচ্ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে মৌসুম জরিপ করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা দেশব্যাপী চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। সারা দেশে পর্যাপ্ত ফ্লুইড সরবরাহ করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসককে গাইডলাইন মেনে চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করছি পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।’
এ বছর প্রাক মৌসুম জরিপ করা হয় এপ্রিল মাসে। ফল প্রকাশ করা হয় ২৮ মে। জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটির ওয়ার্ডগুলোর বাড়িতে ১৪ শতাংশের বেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। গত বছর বর্ষার আগের এমন জরিপে ৪ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। এডিস মশার ঘনত্বের সূচককে ব্রুটো ইনডেক্সে প্রকাশ করা হয়। এর হার ২০-এর বেশি হলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। দেখা গেছে, দক্ষিণের ২৯টি ওয়ার্ড এবং উত্তরের ১২টি ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্সের হার ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, গত মঙ্গলবার রোগটিতে মৃত্যু হওয়া পাঁচজনের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের দুজন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে দুজন এবং খুলনা বিভাগে আরও একজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে ১০২ জন মারা গেলেন। মাসের হিসাবে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরের গত ১০ দিনে ডেঙ্গুতে ১৯ জন, আগস্টে ২৭, জুলাইয়ে ১২, জুনে ৮, মে মাসে ১২, এপ্রিলে ২, মার্চে ৫, ফেব্রুয়ারিতে ৩ এবং জানুয়ারিতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। বিভাগীয় হিসাবে দেখা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১০২ জনের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে রয়েছেন ৫৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪, বরিশাল বিভাগে ১০, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৯, খুলনা বিভাগে ৫, ঢাকা বিভাগে ৩, ময়মনসিংহ বিভাগে ১ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশেনে একজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ১০২ জনের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী এবং ৪৮ শতাংশ পুরুষ।
এদিকে গতকাল বুধবার নতুন করে আরও ৪৬৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে এ সময় কারও মৃত্যু হয়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৩৮৩ জন। চলতি বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ১৭ হাজার ২৮৪ জন। ছাড়পত্র নিয়েছেন ১৫ হাজার ৪৩৬ জন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এসব তথ্য জানানো হয়।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ বলেন, ‘ডেঙ্গুর বিষয়টিকে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। ঢাকার বেশিরভাগ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা ডেডিকেটেড কর্নার করা হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের জনবলকে ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছে।’