যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, জড়িয়েছেন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে। ব্যয় বাড়িয়েছেন প্রকল্পের। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের প্রভাবশালী পরিচালক ছিলেন। ক্ষমতার প্রভাবে থোড়াই-কেয়ার করতেন বিরোধী মতাদর্শের কর্মকর্তাদের। তুচ্ছ কারণে চাকরিচ্যুত, এমনকি মামলার আসামিও করতেন। অবৈধভাবে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সদ্য সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বিশ্বস্ত হিসেবে ছিলেন অনেক অপকর্মের সহযোগী। তবে ভোল পাল্টেছেন কয়েকদিনের মধ্যেই। পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগ পরিচয় দেওয়া এ প্রকৌশলী এখন শোডাউন দিচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীদের দিয়ে। পরিচয় দিচ্ছেন বিএনপির সমর্থক হিসেবে। অথচ ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর তিনি নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় অবসর। নির্যাতিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে নগর ভবন ছাড়াও হয়েছিলেন। আলোচিত এ ব্যক্তি হলেন ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমান।
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, আশিকুর রহমান ১৯৯৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ডিএসসিসিতে সহকারী প্রকৌশলী (পুর) হিসেবে যোগদান করেন। পরে সহকারী প্রকৌশলী পদ থেকে মাত্র এক দিনের মধ্যেই নির্বাহী প্রকৌশলী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পান। সর্বশেষ দুই বছর আগে নিয়মবহির্ভূতভাবে বাগিয়ে নেন প্রধান প্রকৌশলীর পদ। ২০১৫ সালে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে টোল-সংক্রান্ত দুর্নীতিতে আশিকুর রহমানকে সিটি করপোরেশন থেকে সরিয়ে নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। তখন তাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানেও নানা অপকর্মে জড়িয়েছিলেন তিনি।
২০২১ সালের ৭ জুন আবার তাকে নগর ভবনে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেন সাবেক মেয়র শেখ তাপস। ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ১৩ আগস্ট স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের আবেদন করেন আশিকুর রহমান। সেই আবেদন গৃহীত হয়নি। দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচরণ, অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগে গুরুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধের কথা উল্লেখ করে পরদিন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
আশিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নগর কর্তৃপক্ষ। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের সময়কালে গঠিত টাস্কফোর্স আশিককে দক্ষিণ সিটির ১ নম্বর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করে। এর পরও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুকৌশলে সরকারি দলের নেতাদের ম্যানেজ করে বাগিয়ে নেন একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদ। পরিচয় দিতেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে।
জানা যায়, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার প্রকল্পে দুর্নীতির আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক আশিক। বিএনপি সরকারের আমলে এই প্রকল্পের উদ্বোধন হয়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৭০ কোটি টাকা। এরপর ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় বন্ধ থাকে কাজ। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক আশিকুর রহমান প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে করেন ২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে উদ্বোধনের সময়ে মেয়রের দায়িত্বে থাকা বিএনপির প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেন খোকাকেও দাওয়াত দেওয়া হয়নি। প্রকল্প পরিচালক নিজেকে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে এমন কাজ করেন। এ ছাড়া মতিঝিল সিটি সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পে অসম চুক্তি করেন। এই প্রকল্পে ৭৮ ভাগ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং মাত্র ২২ ভাগ পায় সিটি করপোরেশন। এমন অসম চুক্তি করলেও আশিকুরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একই ধরনের আরেকটি প্রকল্প সানমুন টাওয়ার নির্মাণ। এই প্রকল্পে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান পায় ৭৫ ভাগ এবং করপোরেশন পায় ২৫ ভাগ। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় মামলা হয় তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এবং প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শিহাবউল্লাহর বিরুদ্ধে। ওই মামলায় দীর্ঘদিন জেল খাটেন প্রকল্প পরিচালক। একই ধরনের দুর্নীতি করেও রেহাই পেয়ে যান সিটি সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক আশিকুর রহমান।
বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনে পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে চাকরি করার সময়ও জড়িয়েছেন দুর্নীতিতে। সেই দুর্নীতির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এ ছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পরিচালক পদে থাকার সময়েও লুটপাটে জড়িয়েছেন এ প্রকৌশলী। অভিযোগ রয়েছে, হানিফ ফ্লাইওভারের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ থেকে তিনি দুটি গাড়ি উপহার নিয়েছেন, যার একটি তার স্ত্রী এবং অন্যটি মেয়ে ব্যবহার করেন। দুর্নীতির টাকায় আশিকুর রাজধানীর অভিজাত এলাকায় গড়ে তুলেছেন একাধিক বাড়ি এবং ফ্ল্যাট। রয়েছে বেশ কয়েকটি আলিশান গাড়িও। এ ছাড়া দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আশিকুরের কমিশন নেওয়ার কারণে থমকে ছিল উন্নয়ন কাজও। ঠিকাদাররা দীর্ঘদিন ধরে কাজ নিতে চান না। এ কারণে একটি কাজের বিপরীতে তিন-চারবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিতে হয়েছে।
গত সোমবার নগর ভবনে আশিকুর রহমানকে শুভেচ্ছা জানান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সাবেক সদস্য মুকিতুল হাসান রঞ্জু, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক নেতা মেহেদী হাসান লিটু, বহিষ্কৃত নেতা জাকির হোসেন, শ্রমিক দলের নেতা আরিফুজ্জামান প্রিন্স ও আহসান মানদুদসহ বিএনপি নেতাকর্মীরা। এর আগে নগর ভবনে প্রবেশকালে সামনে ছিলেন আশিকুর রহমান এবং তার পেছনে ছিলেন বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মী। এরপর আশিককে নিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর রুমে যান নেতাকর্মীরা।
দক্ষিণ সিটির শ্রমিক দলের কয়েকজন নেতা জানান, বরখাস্তের অফিস আদেশের পর আশিকুর রহমান বিভিন্ন বিএনপি নেতাদের কাছে ধরনা দেন। তবে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী এবং শেখ হাসিনার কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক হওয়ায় কেউই তাকে পাত্তা দেননি। এরপর আশিক ছুটে যান করপোরেশনের সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাসের কাছে। সেখানেও ইতিবাচক কিছু মেলেনি। সর্বশেষ বিএনপি সমর্থক মুকিতুল হাসান রঞ্জু ও মেহেদী হাসান লিটুর সহযোগিতা নিয়ে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পরই বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মী নিয়ে তিনি নগর ভবনের প্রবেশ করেন। শোডাউন দিয়ে প্রবেশকালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে করপোরেশনজুড়ে। করপোরেশনের কর্মকর্তা এবং প্রকৌশলীদের রুমে রুমে গিয়ে আশিকুরকে মেনে নিতে হুমকি দেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস। এর পরই প্রকৌশলী আশিকুর রহমানকে নিজ দপ্তরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন ডিএসসিসির বিএনপিপন্থি প্রকৌশলীরা। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাকে অপসারণের দাবি করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। ডিএসসিসির একজন নির্বাহী প্রকৌশলী কালবেলাকে বলেন, অনেক উন্নয়নকাজ আশিকুর রহমানের জন্য আটকে গেছে। প্রকৌশলী, কর্মীরা তার কাছে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আমরা সবাই নির্যাতিত তার কাছে। যেসব কর্মচারী ছিল, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আমাদের প্রকৌশলীদের দুর্ব্যবহার, নির্যাতন করতেন। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।
জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক শরিফ হোসেন বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ এই প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। অফিস আদেশ ছাড়াই অবৈধভাবে তিনি আবার অফিসে বসেছেন। এটা অবৈধ। সাবেক মেয়র তাপসের আমলে আশিকুর আমাকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং পুলিশ দিয়ে নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আদালতে নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার পরও অবৈধভাবে বরখাস্ত করেছে। আশিকুর আওয়ামী লীগের এজেন্ট। তাকে স্বপদে ফেরাতে বিএনপির বড় বড় নেতা সুপারিশ করছেন।’
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে এমন অনিয়ম চলে এলেও ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ আশিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিভিন্ন সময়ে ঠিকাদারদের ফাইল আটকিয়ে ঘুষ গ্রহণের বিষয়টিও ছিল ওপেন সিক্রেট। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার মেয়রের কাছে অভিযোগও করেছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে আশিকুর রহমানের অব্যাহত অপেশাদার আচরণ ও দুর্ব্যবহারে অভিযোগ করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘সাতত্য’। তারা জানায়, সাড়ে তিন বছর ধরে সেবার বিপরীতে কোনো ধরনের বিল পাচ্ছে না তারা। এর পরও সিটি করপোরেশনকে উন্নয়নমূলক কাজে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু তারা এই সেবা আর দিতে চায় না।
অভিযোগের বিষয়ে আশিকুর রহমান সাংবাদিকের জানিয়েছেন, আমার বিরুদ্ধে হানিফ ফ্লাইওভারসহ যেসব প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো বায়বীয়। এর কোনো ভিত্তি নেই। আর আমার বিরুদ্ধে আদালত স্থগিতাদেশ দেওয়ার পর নতুন কেউ দায়িত্ব নেননি। ফলে আমার কারও কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
বরখাস্ত প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা আইনগতভাবে মোকাবিলা করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির প্রশাসক ড. মুহ. শের আলী। তিনি বলেন, আশিকুর রহমানের সাময়িক বরখাস্তের আদেশটি আদালত সাময়িক স্থগিত করেছেন। আমরা এখনো আদালতের আদেশটি পাইনি। আদালত থেকে আদেশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থায় অফিসিয়ালি আসতে একটু সময় লাগে। আমরা দ্রুতই আদেশ পেয়ে যাব। পেলে করপোরেশনের আইনজীবীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইনি কার্যক্রম নেওয়া হবে।