পুড়ে যাওয়া কারখানার সামনে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব রেহেনা বেগম। কিছুক্ষণ পরপর মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘আমার সোনার টুকরা পোলারে আইনা দেও তোমরা। আমি আর বাঁচুম না। আমি কিছু চাই না। আমার পোলার কঙ্কাল দেহটা আইনা দাও।’
রেহেনা বেগমের মতো অনেকে কারখানার মূল ফটকের সামনে বিলাপ করছিলেন। তারা দুদিন ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কখন তার বুকের ধনকে ফেরত পাবেন। সেটা হোক মৃত বা দেহের হাড়গোড়। দুদিন হয়ে গেলেও উদ্ধারকাজ না চলায় তারা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনার শুরুতে ১৪ জনকে উদ্ধার করেছে। এখনো কারখানার ভবনটিতে আটকা পড়ে ১৭৬ জন ব্যক্তি নিখোঁজ বলে দাবি করেছেন তাদের স্বজনরা। নিখোঁজদের সন্ধানে স্বজনরা কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে ভিড় করছেন।
গন্ধর্বপুর এলাকা থেকে আসা লিপি আক্তার বলেন, আমার ছোট ভাই আলামিন তার বন্ধু মাহফুজের সঙ্গে গাজী টায়ার কারখানায় রোববার রাত ৯টার দিকে যায়। এরপর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসীতে অবস্থিত গাজী টায়ার কারখানায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার ৩২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও নিখোঁজদের উদ্ধার কার্যক্রম করতে পারেননি ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। গতকাল বিকেল পর্যন্ত কারখানার ৬তলা ভবনটির ভেতরে থেমে থেমে আগুন জ্বলছিল। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তখনো আগুন নেভানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। দীর্ঘ সময় আগুন থাকায় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। খসে খসে পড়ছে আস্তর ও ইটের গাঁথুনি।
ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘসময় ধরে আগুন জ্বালার কারণে ভবনটি ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ভবনের আগুন নিভে গেলেও ভেতরে ধোঁয়া ও তাপের কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনে প্রবেশ করতে পারছেন না। তবে পানি দিয়ে তাপ ও ধোঁয়া কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। তাপ ও ধোঁয়া কমে গেলে হয়তো উদ্ধার অভিযান শুরু হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত রোববার রাতে প্রায় সাত-আটশজন লোক গাজী টায়ার কারখানায় লুটপাটের জন্য প্রবেশ করে। এ সময় মালপত্র লুট নিয়ে তাদের মধ্যে দুটি পক্ষ তৈরি হয়। একপক্ষ পাঁচ-ছয়তলা থেকে মালপত্র নিচে ফেলে। এ সময় আরেক পক্ষ নিচে নেমে এসে নিচ তলার শাটার লাগিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এর মধ্যে বরাব এলাকার সহিদুল ও মিজান নামে দুই ব্যক্তি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, তারা আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সদস্য ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী।
আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট প্রথম ঘটনার পর কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর তোফাজ্জল মোল্লার ছেলে বাবু মিয়া, হাবিবুল্লা, তাইজদ্দিনের নেতৃত্বে শতাধিক যুবক কারখানার পাহারায় দায়িত্ব নেয়। তাদের মধ্যেও পরে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়। বাবুর নেতৃত্বে ৪০ জন যুবক এরপর থেকে পাহারা দিত। বাকি ৬০ জন আর আসেনি।
আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গাজী টায়ার্সে আগুনের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে পুড়ে যাওয়া কারখানা পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক। এ সময় তিনি বলেন, ভবনের ভেতরে সালফারসহ কেমিক্যাল থাকার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও তাপ ও ধোঁয়া রয়ে গেছে। এ কারণে উদ্ধার কাজ চালানো যাচ্ছে না। দ্রুতই উদ্ধারকাজ শুরু করা হবে। নিখোঁজদের একটি তালিকা তৈরি করার কথাও বলেন তিনি।
এদিকে গতকাল সকালে পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিটের পরিদর্শক জাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পুড়ে যাওয়া কারখানা পরিদর্শন করেছে।