কোটা সংস্কার আন্দোলন, সরকার পতন এবং পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এক মাস বন্ধ ছিল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে সেনা সদর দপ্তরের নির্দেশনায় স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা গত ৭ আগস্ট থেকে খোলা থাকলেও উপস্থিতি ছিল খুবই কম। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুলেছে। তবে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা পুরোদমে খুললেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। উপাচার্যসহ প্রশাসন না থাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালু হলেও শিক্ষার্থী কম।
এর আগে গত ১৫ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা আদেশে জানানো হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। এসব পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। উপাচার্য না থাকা বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রমে এখনো স্থবিরতা বিরাজ করছে। গত ১ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের আন্দোলনের কারণে ক্লাস-পরীক্ষাসহ পুরো দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর অফিসগুলো খুললেও শ্রেণি কার্যক্রম ও পরীক্ষা শুরু হয়নি। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা থাকলেও সেটি হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার কালবেলাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় খোলাই আছে, তবে শ্রেণি কার্যক্রম নিয়ে আমরা ভাবছি। এখন যে পরিস্থিতি চলমান সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অভিভাবক অর্থাৎ উপাচার্য প্রয়োজন। এই ক্রান্তিকালে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলা বা ব্যবস্থাপনায় একটা অভাব পড়ে গেছে। তারপরও আমাদের শিক্ষকরা ক্লাস নেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। শিক্ষার্থীরা সহযোগিতা করলে তা খুবই তাড়াতাড়ি সম্ভব।
তিনি বলেন, আগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনাটা খুবই জরুরি। কারণ, তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান স্টেকহোল্ডার। আর আলোচনায় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম। উপাচার্যসহ প্রশাসনিক পদগুলো খালি হয়ে পড়ায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল এবং প্রশাসনের পদত্যাগের জোর দাবিতে গত ১২ আগস্ট পর্যন্ত চবির উপাচার্য উপ-উপাচার্যদ্বয়, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রেস প্রশাসক, প্রক্টরিয়াল বডি ও হলগুলোর প্রভোস্টরাসহ বিভিন্ন আবাসিক শিক্ষকরাও পদত্যাগপত্র জমা দেন। এরপর থেকেই কার্যত অচল হয়ে পড়েছে একাডেমিক কার্যক্রম। এর আগে ৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত ৫৫২তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে আবাসিক হলগুলোর সিট বরাদ্দ কার্যক্রম এবং আজ ১৯ আগস্ট থেকে একাডেমিক কার্যক্রম চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়। তা ছাড়া ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিধানের স্বার্থে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবাসিক হলসমূহে নতুনভাবে সিট বরাদ্দ না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে প্রবেশ না করার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখা থেকে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক লোকবল না থাকায় আবাসিক হলগুলোতে নতুন করে সিট বরাদ্দের বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে কবে শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে এবং কবে নাগাদ একাডেমিক কার্যক্রম সচল হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে ক্লাস-পরীক্ষায় বসতে না পেরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার ছাপ দেখা যাচ্ছে। ১৯ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে অনেকেই ইতোমধ্যেই ক্যাম্পাসে চলে এসেছেন; কিন্তু হলে উঠতে না পেরে পড়েছেন বিপাকে।
তা ছাড়া যারা আসবেন বলে ট্রেন বা বাসের অগ্রিম টিকিট কেটেছিলেন, তারাও পড়েছেন ঝামেলায়। এমন মুহূর্তে তাদের দাবি—দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হোক। ছাত্রত্ব আছে এমন শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তত আবাসিক হলগুলো খুলে করে দেওয়া হোক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমেদ বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারি না। আমাদের সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত লাগে। সিন্ডিকেট না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব না। আর উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সিন্ডিকেট সভা হবে না। উপাচার্য ছাড়া অন্য কেউ সিন্ডিকেট সভা ডাকতে পারেন না।
প্রশাসনিক কার্যক্রম কেমন চলছে প্রশ্নের উত্তরে রেজিস্ট্রার বলেন, এখন উপাচার্য নেই, উপ-উপাচার্য নেই, প্রভোস্ট নেই, প্রক্টর নেই, ছাত্র উপদেষ্টা নেই, পুলিশ নেই—এগুলো করবে কে। এসব প্রশাসনিক পদ খালি থাকায় সিদ্ধান্তমূলক কার্যক্রমগুলো হচ্ছে না। শুধু রুটিন কাজ চলছে।
এদিকে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছাড়াই ব্যক্তি উদ্যোগে তিনটি বিভাগের ক্লাস শুরু হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় প্রথমে সমাজকর্ম বিভাগের ক্লাস শুরু হয়। এ ছাড়া ইসলামিক স্টাডিজ ও ফোকলোর বিভাগের শিক্ষকরা ক্লাস নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। শিক্ষকরা বলছেন, প্রশাসনিক বডি না থাকায় ক্লাস-পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিভাগগুলো। যেহেতু ক্লাস নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে। তাই বিভাগ চাইলে ক্লাস নিতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও ক্যাম্পাসেও শিক্ষার্থীদের তেমন আনাগোনা দেখা যায়নি।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান কার্যক্রমে ফিরেছে। চালু ছিল দাপ্তরিক কার্যক্রম। গতকাল সকাল থেকে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বেড়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে যায়নি। বেশকিছু বিভাগে পাঠদান বন্ধ ছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠদান শুরু হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি)।