দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই তরুণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন। এটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা সম্ভব হয়েছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ এখন তরুণ সমাজের প্রতিনিধি। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হওয়ায় তরুণ সমাজ খুশি, উচ্ছ্বসিত, উদ্বেলিত। একই সঙ্গে তাদের কাছে তরুণ সমাজের প্রত্যাশাও অনেক বেশি।
তরুণ সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, বিগত সরকারগুলো ক্ষমতাসীন থাকাকালীন তরুণদের সঙ্গে তাদের একটি বড় ফারাক (গ্যাপ) তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও যৌক্তিক দাবি আদায় করতে গিয়ে বারবার সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে ভিন্ন রাজনীতির ট্যাগ পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রবীণ হওয়ায় তারা তরুণদের মন বুঝতে পারেননি। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন ভিন্ন অন্য সংগঠনের ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়েও দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা থাকা শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছেন। চাকরিতে কোটা ও তদবিরে পিষ্ট হওয়া অনেক তরুণই সরকার ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন চেয়েছেন। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে হতাশ তরুণ সমাজের দাবিও ছিল একই।
এমন একটি পরিস্থিতিতে দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হওয়া শুরু করল। এরপরও আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষার্থীদের মন বুঝল না। উল্টো তাদের জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন ট্যাগ দিতে থাকল। তাদের এই ট্যাগের রাজনীতির কারণে বর্তমান ডিজিটাল তরুণ সমাজ বারুদের মতো জ্বলে উঠল। এই স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হলো সর্বস্তরের মানুষ। ৩৬ দিনের আন্দোলনের পরে শেখ হাসিনা সরকার পিছু হটে। পদত্যাগ করে বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। বর্তমানে দলটির অবস্থাও নাজুক।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জায়গা করে নিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের দুই নেতা মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এর মধ্যে নাহিদ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং আসিফ যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
এর মাধ্যমে নতুন ইতিহাস গড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ দুই সমন্বয়ক। দুজনই বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। নাহিদ সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ও আসিফ ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে পড়ছেন। ইতিহাস বলছে, ৩০ বছর বয়সের কম কেউ কখনোই সরকারের উপদেষ্টা হতে পারেননি। এবারই প্রথমবারের মতো দুই তরুণ জায়গা পেয়েছেন, যাদের বয়স ৩০ বছরের কম। সার্টিফিকেট অনুযায়ী নাহিদ এবং আসিফ দুজনের বয়সই ২৬ বছর। শুধু উপদেষ্টা নয়, সংসদ সদস্যও এত কম বয়সে হওয়ার নজির নেই। তারা উপদেষ্টা হওয়ায় তরুণ সমাজ যেমন খুশি, একইভাবে তাদের প্রত্যাশার পারদও অনেক বেশি।
নিজের যে দায়িত্ব এখন অনেক বেশি, সেটি জানেন নাহিদ ইসলামও। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট রেজিম ব্যবস্থার পরিবর্তন, নতুন রাষ্ট্র কাঠামো গঠন, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণহত্যার বিচারসহ অভ্যুত্থানের যেসব দাবি ছিল, সেগুলো পূরণে সচেষ্ট থাকব। পাশাপাশি ছাত্রদের জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করব। আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি। তাই তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেব।’
ছাত্রপ্রতিনিধিদের সরকারে পেয়ে খুশি তরুণ সমাজ। তারা জানিয়েছেন তাদের অনুভূতি, একই সঙ্গে প্রত্যাশার কথাও। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে গঠিত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি ম্যাচিউর। তারা সবকিছু বোঝে। সে হিসেবে ছাত্র প্রতিনিধিদের সরকারে থাকাকে ইতিবাচকভাবে নিচ্ছি। আগামীতে তরুণ সমাজই বাংলাদেশে নেতৃত্ব দেবে, এটি তার প্রমাণ। পাশাপাশি আগের সরকারগুলোর লাগামহীন দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে তাদের। সে কারণে তাদের ওপর দায়িত্বের বোঝাও অনেক। তারা দেশ সংস্কারে মনোযোগ দেবে এবং এমন একটি দেশ গঠন করবে যাতে পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সরকার ক্ষমতায় এলেও দুর্নীতি ও অপরাধ করার সাহস না পায়।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক বোরহান উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব খুবই আশাব্যঞ্জক। পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই বলে অনেকেই হয়তো সমালোচনা করছেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর বিগত সময়ের কার্যক্রম আমরা দেখেছি। সে কারণে এই পট পরিবর্তন দেখে আমরা তরুণ সমাজ আশাবাদী।’ তিনি বলেন, ‘সব শ্রেণি-পেশার মানুষ চেয়েছিল সরকারে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব থাকুক। শুধু তাই নয়, দেশের বাইরে যেসব তরুণ আছেন, তারাও এটি চেয়েছিলেন। কারণ সরকারের নীতিনির্ধারকদের বয়স বা রাজনৈতিক ভিন্নতাসহ বিভিন্ন কারণে তরুণদের সঙ্গে তাদের একটি গ্যাপ ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুইজন তরুণ প্রতিনিধি সেটি পূরণ করবে বলে আশা করা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসী তরুণরা যাতে উপযুক্ত সম্মান পান, সেই প্রত্যাশা থাকবে। বেকার তরুণরা চাকরির পাশাপাশি এই সেক্টরে স্বচ্ছতা চান। বহু তরুণ কৃষিকাজ করতে চান, উদ্যোক্তা হতে চান। কিন্তু লোন, মূলধনসহ বিভিন্ন কারণে সেটি পারেন না। তরুণ প্রতিনিধিরা এসব বিষয়ে নজর দেবেন বলে আশা রাখি।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট অরণি সেমন্তি খান কালবেলাকে বলেন, ‘ছাত্ররা প্রতিনিধি হওয়ায় অনেক খুশি এবং তাদের নিয়ে আশাবাদীও। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা প্রতিনিধি হয়েছে বলেই আশা বেশি। তারা বুড়োদের থেকে কম দুর্নীতি করবে, এমনটা আশা করাই যায়। আমি চাই তারা সংবিধানের এমন সংস্কার করুক যাতে পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট কোনো সরকার ক্ষমতায় আসতে না পারে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বজায় রাখা যায়।’
জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর রাশেদুজ্জামান রাকিব (আরএনএআর) কালবেলাকে বলেন, ‘তরুণ প্রতিনিধি পেয়ে অনেক খুশি। এমনটা কিছুদিন আগেও কল্পনার বাইরে ছিল। তরুণরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারাই এখন আমাদের হয়ে সরকারে প্রতিনিধিত্ব করবেন। এটি একই সঙ্গে যেমন আনন্দের, তেমনি গর্বের। আশা করি ওনারা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন, নজরকাড়া পরিবর্তন আনতে পারবেন, যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অনেক শুভকামনা রইল।’
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্য সমন্বয়কেরাও তাদের প্রতিনিধিদের সরকারে পেয়ে অনেক খুশি। ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের কালবেলাকে বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পরে আকাঙ্ক্ষার জায়গা ছিল ছাত্ররা দেশ গঠনে নেতৃত্ব দেবে। সেটি নিশ্চিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সরকারে। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য আনন্দের।’ তিনি বলেন, ‘আগের সরকারগুলোর ক্ষেত্রে দেখেছি, নেতারা বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত। ছাত্র প্রতিনিধিরা সেটি করবে না বলেই বিশ্বাস করি এবং দুর্নীতি ও অপরাধ দমনে ভূমিকা রাখবে। তবে এই মুহূর্তে সবার আগে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে।’
আরেক সমন্বয়ক স্বর্ণা আক্তার রিয়া কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি, এটি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হয়েছে। এজন্য আমরা অনেক খুশি ও উচ্ছ্বসিত। এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি থাকবে না, এটি ছাত্রপ্রতিনিধিদের নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার মাধ্যম তারা, আশা করি তারা ছাত্রদের দাবিগুলোতে গুরুত্ব দেবেন এবং দাবি আদায় করবেন।’
সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, ‘ছাত্রপ্রতিনিধি সরকারে, এটি ভেবেই আমরা সবাই অনেক উচ্ছ্বসিত। নাহিদ ভাই পলকের আর আসিফ ভাই পাপনের জায়গায় গিয়েছেন। সাবেক এই দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনেক। আশা করি, এসব দপ্তরের প্রকৃত চিত্র আমরা এখন দেখতে পাব। পাশাপাশি তারা (নাহিদ ও আসিফ) যেহেতু ছাত্রদের প্রতিনিধি, ছাত্রদের দাবি-দাওয়া তারা পূরণ করবেন।’