হঠাৎ মায়ের কাছে খবর এলো, ‘আপনার ছেলের গায়ে গুলি লেগেছে, তাড়াতাড়ি আসেন।’ হতদরিদ্র মায়ের কাছে তখন রিকশা ভাড়াও ছিল না। রিকশাওয়ালাকে হাতে-পায়ে ধরে কোনোরকমে যাত্রাবাড়ী গিয়ে দেখেন রাস্তায় পড়ে আছে ছেলে ইয়াসিন শেখের নিথর দেহ। বাঁচার আকুতিতে তখনো কাতরাচ্ছে ইয়াসিন। মাকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলতে থাকে ‘মা, আমি তো মিছিলে যাই নাই। গ্যাস নিয়ে কাস্টমারের বাড়ি যাচ্ছিলাম, আমার গায়ে গুলি করল কেন।’
অথচ এই ছেলেই সকালে বাসা থেকে কাজে বের হওয়ার সময় মাকে বলেছিল, ‘মা, সারা জীবন আমাদের কয় ভাইবোনের জন্য মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছ। কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেছ। এখন আমি কাজে ঢুকছি। এবার থেকে তুমি বাসায় থাকবা, আমি কাজ করব।’
তার এমন আবেগি কথা শুনে মা মনজিলা বেগমও সেদিন চলে গিয়েছিলেন পুরোনো কাগজের কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতে। হঠাৎ খবর এলো, আপনার ছেলের গায়ে গুলি লেগেছে তাড়াতাড়ি আসেন। তড়িঘড়ি করে যাত্রাবাড়ী পৌঁছে দেখেন সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে ছেলে ইয়াসিন। পরে তাকে নেওয়া হয় রাজধানীর মুগদা মেডিকেলে। সেখানে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত বৃহস্পতিবার তার মৃত্যু হয়। আর মা মনজিলা বেগম হারান বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত-সহিংসতা চলাকালীন গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে গ্রাহকের বাসায় যাওয়ার সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয় এই কিশোর। টানা ছয় দিন রাজধানীর মুগদা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থাকার পর জীবনপ্রদীপ নিভে যায় ইয়াসিনের। যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকায় ছোট্ট একটি ঘরে মা আর বোনকে নিয়ে ভাড়া থাকত সে।
কিশোর ইয়াসিনের জন্ম খুলনার রূপসা উপজেলায়। ইয়াসিনের বয়স যখন মাত্র দুই, তখনই ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যায় তার বাবা নুর ইসলাম শেখ। পরপর তিন মেয়ে এবং দুই বছরের ছেলে ইয়াসিনকে নিয়ে মা মনজিলা বেগমের ঠাঁই হয় খুলনার রূপসার উপজেলার রহীমনগরে বিধবা মায়ের ভাড়া করা কুঁড়েঘরে। সেখানেই বেড়ে ওঠে ইয়াসিন শেখ। আর্থিক অনটনে পড়াশোনাও করা হয়নি। মানুষের বাড়ি কাজ করে মনজিলা বেগম তার তিন মেয়ে নুরজাহান, নাসরীন ও শারমিনকে কোনোরকম বিয়ে দেন। ছোট মেয়ে শারমিনের সংসার না টেকায় বছর দুয়েক আগে মেয়ে আর ১৫ বছরের ইয়াসিনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন মনজিলা বেগম। মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানো মনজিলা ও তার মেয়ে শারমিন একটি কাগজের কারখানায় কাজ নেন গত ছয় মাস আগে। ইয়াসিন একটি এলপি গ্যাসের দোকানে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করত।
ওইদিনের ঘটনায় পেটের মধ্যে গুলি লেগে পেছন থেকে বের হয়ে যায় ইয়াসিনের। মুগদা মেডিকেলে ছয় দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত ২৫ জুলাই রাতে মৃত্যুর কাছে হার মানে ইয়াসিন। আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে গত ২৬ জুলাই রাতে খুলনার রূপসায় রহীমননগরে নানির সেই ভাড়া বাড়িতে আসে ইয়াসিন, কিন্তু লাশ হয়ে।
ইয়াসিনের মা মনজিলা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘চার ছেলেমেয়েকে ছোট রেখে ১৫ বছর আগে আমার স্বামী মারা যায়, দুই বছরের ইয়াসিনের মুখের দিকে তাকিয়ে এতটা বছর বেঁচে আছি। এই আমার ছেলে কাজ শুরু করেছে। যেদিন গুলি খেলো, সেদিনও আমাকে বলেছে আর আমাকে কাজ করতে দেবে না। আমার ছেলে পড়াশোনা করেনি টাকার অভাবে। কোনো রাজনীতি করে না। আমার ছেলে কেন গুলিতে মরল, আমার তো আর কেউ থাকল না। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব। আমি আমার সন্তানের হত্যার বিচার চাই।’
ইয়াসিনের বোন নুরজাহান কালবেলাকে বলেন, ‘আমি আর আমার মা সবাই এক কারখানায় কাজ করি। কাজে বসে খবর পাই, আমার ভাইকে গুলি করেছে। আমার ভাই ছোট থেকে অনেক কষ্ট করতে করতে বড় হইছে। আমার বাপ মারা গেছে ছোটবেলায়, এই ভাই ছাড়া আমাদের কেউ নেই।’
ইয়াসিনের বন্ধু সাগর কালবেলাকে বলে, ‘ইয়াসিন খুলনায় আমাদের সঙ্গেই থাকত। বয়সে আমাদের থেকে ছোট হলেও সে খুবই নম্র-ভদ্র ছিল। বাপ না থাকায় সবাই ওকে ভালোবাসতো। কাজের জন্য দুই বছর আগে ঢাকা গেল। কয়েকদিন আগে কথা হলে তাকে বলেছিলাম, খুলনায় আয় বেড়িয়ে যা। কিন্তু ও খুলনায় এলো; কিন্তু মৃত অবস্থায়। ওরা এত গরিব যে, লাশ খুলনায় আনতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াও ছিল না। আমরা এখান থেকে রূপসা খেয়াঘাটে সাহায্য উঠাইয়া পাঠাইছি, তাই দিয়ে লাশ খুলনায় এনে দাফন করা হয়েছে।’