আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৪, ০২:১১ এএম
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৪, ০৭:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছয় মাসও টিকল না অনেকের পাঠ্যবই

নিম্নমান
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর লালবাগের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে শরীফ মাহমুদ। ছয় মাস যেতে না যেতেই তার গণিত, ইংরেজি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানসহ বেশ কয়েকটি পাঠ্যবই ছিঁড়ে গেছে। শরীফের বাবা ছগির হোসাইনকে এখন হন্যে হয়ে নতুন বই খুঁজতে হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে তিনি গণিত, ইংরেজি ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বই পেলেও অন্যগুলো সংগ্রহ করতে পারেননি।

ছগির হোসাইন কালবেলাকে বলেন, আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখন এক বছরের বই দিয়ে কয়েক বছর পড়া যেত। আমি নিজেও পুরোনো বই দিয়েই পড়াশোনা করেছি। কিন্তু এখন বাচ্চাদের যেসব বই দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো ছয় মাসও টিকছে না। আমার ছেলে যে বইগুলো বেশি পড়ে, সেগুলোর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে ছিঁড়ে গেছে। পৃষ্ঠাগুলোও অনেক পাতলা; মনে হচ্ছে নিউজপ্রিন্টে ছাপা। তিনি বলেন, ওর প্রায় সব বই ছিঁড়ে গেছে। ছেলেটা ছেঁড়া বই নিয়ে স্কুলেও যেতে চায় না। তাই বাড়তি দাম দিয়েই তিনটি বই কিনে দিয়েছি। কিন্তু বিভিন্ন লাইব্রেরি ঘুরেও বাকিগুলো পাইনি।

ঝিনাইদহের মুরারীদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, বছরের অর্ধেক না পেরোতেই তাদের বেশিরভাগ বই ছিঁড়ে গেছে। সে কারণে বিদ্যালয়টির শিক্ষকরা বইগুলো দ্রুত সেলাই করার পরামর্শ দিয়েছেন। বিদ্যালয়টির শিক্ষক আলম পারভেজ জানান, অনেক শিক্ষার্থীর বই ছিঁড়ে গেছে। অনেকের বইয়ের একাধিক পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে। বছরের বাকি সময় বইগুলো পড়ার উপযোগী রাখতে শিক্ষার্থীদের বইগুলো সেলাই করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই নিয়ে এমন অভিযোগ অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের। তাদের মতে, বইয়ে ব্যবহৃত কাগজ খুবই নিম্নমানের। সে কারণে বছরের অর্ধেক পেরোতেই বই ছিঁড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা। অন্যদিকে পাঠ্যবই ছাপানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কয়েকজন নির্দিষ্ট প্রেস মালিকের যোগসাজশে নিম্নমানের বই ছাপানো হচ্ছে। সে কারণে এনসিটিবি প্রেসগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

এনসিটিবির তথ্য বলছে, গত বছর থেকে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। সে বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই যায়। চলতি বছর গেছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এবার সারা দেশে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজারের মতো নতুন বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে বই ৯ কোটি ৩৮ লাখের বেশি এবং মাধ্যমিক স্তরের বই ২১ কোটি ৩২ লাখের বেশি।

অভিভাবকদের অভিযোগ, বছরের শুরুতে নতুন বই পেয়ে অনেক ছেলেমেয়েই উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। কিন্তু সে খুশি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ ছয় মাস না পেরোতেই নতুন শিক্ষাক্রমে রচিত পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে গেছে, অনেক বইয়ের মলাট খুলে গেছে। নিম্নমানের কাগজ ও ছাপা এবং সাধারণ বাইন্ডিংয়ের কারণে বইয়ের এমন করুণ দশা বলে জানিয়েছেন তারা। এর ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটছে, পাশাপাশি দুশ্চিন্তা বেড়েছে অভিভাবকদেরও।

এনসিটিবির সাবেক এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, চলতি বছরও নিম্নমানের কাগজে বই ছাপা হয়েছে, এটা সবাই জানে। কোন কোন প্রেস সেসব বই দিয়েছে, তা-ও এনসিটিবির সবাই জানে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধ এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অজানা কারণে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসসহ যাদের বিরুদ্ধেই বিগত সময়ে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর অভিযোগ এসেছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেকের চেয়ার থাকবে না। আবার ইন্সপেকশন কমিটিও প্রেসগুলোর কাছে ‘ম্যানেজ’ হয়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান যতদিন করা না হবে, প্রেসগুলো খারাপ বই দিলেও ইন্সপেকশন কমিটি পজিটিভ রিপোর্ট দেবে এবং এনসিটিবিও কোনো ব্যবস্থা নেবে না, যা দুঃখজনক।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির অভিযোগ, এনসিটিবি ঠিকমতো ইন্সপেকশন করে না। আবার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয় না। সে কারণে নিম্নমানের কাগজে এবারও বই ছাপানো হয়েছে। সমিতি বলছে, আগামী বছর থেকে যাতে ভালো মানের কাগজে বই ছাপানো যায়, সেজন্য সমিতির উদ্যোগে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির একজন ভাইস চেয়ারম্যান কালবেলাকে বলেন, গত বছর কাগজের অভাব ছিল। বইয়ের উজ্জ্বলতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে কারণে চলতি বছর নিম্নমানের বই গেছে। সেক্ষেত্রে কিছুটা দায় প্রেসের আছে, আবার কিছুটা এনসিটিবিরও রয়েছে। আগামী বছরের বইয়ের জন্য কাগজের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে কারণে এসব বইয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা করা যায়।

সমিতির চেয়ারম্যান মো. রাব্বানী জব্বার বলেন, প্রেস ও এনসিটিবির মাঝখানে ইন্সপেকশন কমিটি রয়েছে। তারা ঠিকমতো পরিদর্শন করলে এবং এনসিটিবি নিম্নমানের বই গ্রহণ না করলে এ সমস্যা থাকে না। এনসিটিবি তাদের আইন অনুযায়ীও ব্যবস্থা নিতে পারে। তা না করায় আজ আমাদের সমিতিরও ইমেজ সংকটে পড়েছে। সে কারণে আমরা দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সমিতির সদস্যদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসব। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির সঙ্গেও বৈঠক করব।

এদিকে সমিতির সাবেক সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, বছরের শুরুতেই আমরা বলেছিলাম এই বই ছয় মাসও টিকবে না। তাই হলো। নিম্নমানের এসব বই সরবরাহের পুরো দায় এনসিটিবির। কারণ মানসম্মত বই নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের। বোর্ডের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণেই এমনটি হয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ফাঁকিবাজির মানসিকতা রাখলেও এনসিটিবি কঠোর হলে সেটির সুযোগ থাকে না। বোর্ড সচেতন হয়ে ভালো বই নিয়ে খারাপ বইগুলো বাতিল করলেই তো হয়। বোর্ড বইয়ের মান নিশ্চিতের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ দেয়। কিন্তু তারা যথাযথ কাজ করে না। বই বিতরণের আগে সেই কমিটি, ডিজি অফিসের (মাউশি অফিস) পাশাপাশি এনসিটিবিও মনিটরিং করে। তার পরও খারাপ বই বাচ্চাদের হাতে যায়। এজন্য কঠোর মনিটরিং লাগবে। যাদের ইন্সপেকশনে গাফিলতি ধরা পড়বে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।

এনসিটিবির সদস্যের (পাঠ্যপুস্তক) দায়িত্ব রয়েছেন মো. সাইদুর রহমান। গত বছর যখন বইগুলো ছাপানো হয়, তখন তিনি এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক ছিলেন। প্রাথমিকের বইগুলো যাচাই-বাছাই শেষে তার হাত দিয়েই উপজেলা পর্যায়ে যায়। জানতে চাইলে সাইদুর রহমান বলেন, বই ছিঁড়ে যাচ্ছে—এমন কোনো অভিযোগ পাইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়তো ব্যবস্থা নেবেন। এটা তার এখতিয়ার।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা বোর্ডের সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মোখলেস উর রহমান কালবেলাকে বলেন, বছরের শুরুতেই অনেক প্রেসের নিম্নমানের বই কেটে ফেলা হয়েছে। এর পরও যারা খারাপ কাগজে বই দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়েও কাজ চলছে।

তিনি বলেন, এনসিটিবি, মন্ত্রণালয়, ডিজি অফিসসহ সবাই এবার বইয়ের বিষয়টি নিয়ে খুবই সিরিয়াস। ভবিষ্যতে যাতে নিম্নমানের কাগজে বই না যায়, সে বিষয়ে যৌথ পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সভাও হয়েছে। দরকার হলে নিম্নমানের বই এবার নেবই না। তিনি আরও বলেন, প্রেসগুলোর সচেতনতাও জরুরি। যে বই তারা নিম্নমানের কাগজে ছাপাচ্ছেন, সেসব বই যে তাদের বাচ্চাদের হাতে যাবে, সেটি তাদের মনে থাকে না। এটি তাদের মনে রাখা উচিত।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দ্বিতীয় সেশনেও টাইগারদের দাপট

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষায় ৮ দফা বাস্তবায়নের দাবি ঐক্য পরিষদের

ভিসার মেয়াদ শেষ আজ, কী ঘটবে শেখ হাসিনার ভাগ্যে

লক্ষ্মীপুরে পিটিআই প্রশিক্ষকের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ

সালমানকে নিয়ে যা বললেন শাবনূর

ট্রাম্পের তথ্য হ্যাক করে বাইডেনকে দিয়েছে ইরান!

শেষ ম্যাচে ৮ উইকেটের বড় জয় বাংলাদেশের

নামাজ পড়ে বাসায় যাওয়া হলো না পুলিশ সদস্য জহিরুলের

বিদেশি শিক্ষার্থী-কর্মীদের কানাডার দুঃসংবাদ

পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ঢাবি প্রশাসনের মামলা

১০

জবির নতুন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক শেখ গিয়াস উদ্দিন

১১

ঢাবিতে মব জাস্টিসের প্রতিবাদে ‘ব্রিং ব্যাক জাস্টিস’ কর্মসূচি

১২

ঢাবিতে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের পরিচয় মিলল

১৩

আ.লীগ নেতা তুষার কান্তি মন্ডল ৭ দিনের রিমান্ডে

১৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ১৫

১৫

ঢাবি ও জাবিতে ‘পিটিয়ে হত্যা’ দুঃখজনক : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৬

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্ত দাবি ঐক্য পরিষদের

১৭

ঢাবির হলে পিটিয়ে হত্যা, তদন্তে প্রত্যক্ষদর্শীদের সহায়তার আহ্বান

১৮

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা হত্যা নিয়ে আ.লীগের বিবৃতি

১৯

গ্যাংস্টারের স্ত্রী পরী মণি 

২০
X