কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে নানা ঘটনার মধ্যে রাজধানীর ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রীদের ওপর হামলা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। গত ১৭ জুলাই বুধবার রাতে আন্দোলনকারীরা তাদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। এ ছাড়া ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় ছাত্রলীগ
নেত্রীদের রুমে রুমে। এমন ঘটনার পেছনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন ধরে জমে ক্ষোভ যেমন ভূমিকা রেখেছে, পাশাপাশি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেত্রীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করছেন কর্মীরা। তবে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী বলছেন, রাজনৈতিক কারণে এভাবে প্রকাশ্য ছাত্রলীগ নেত্রীদের নির্যাতন করা ঠিক হয়নি। এরপর সেই নির্যাতনের ভিডিও করে ভাইরাল করা সব নারী শিক্ষার্থীকে অপমানের শামিল।
জানা যায়, ২০২২ সালের ১৩ মে এক বছরের জন্য ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এক বছরের কমিটিতে দুই বছর পার হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি শাখা ছাত্রলীগের দুই নেত্রী। আবার আংশিক কমিটির ৪৪ জনের মধ্যে ৩০ জনই রাজনীতিতে সক্রিয় নন। কেউ কেউ বিয়ে করে সংসার করেছেন, আবার কেউ চাকরিতে যোগদান করে ছেড়েছেন রাজনীতি। তাছাড়া পদপ্রত্যাশী নেত্রীদের সঙ্গেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কোনো সমন্বয় ছিল না। ফলে ইডেনে ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল একেবারেই নড়বড়ে।
এ ছাড়া ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের এক সহসভাপতি একটি গণমাধ্যমে শাখা ছাত্রলীগের দুই নেত্রীর সিট-বাণিজ্য, নির্যাতন, রুম দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে সাক্ষাৎকার দেন। তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কলেজ প্রশাসন কিংবা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কেউই ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো রাতের আঁধারে সাক্ষাৎকার দেওয়া নেত্রীকে বেধড়ক মারধর করা হয়। পরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মারধর করে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়ে তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। এর পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সাক্ষাৎকার দেওয়া ওই নেত্রীসহ ১৮ জনকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরবর্তী সময়ে ওই নেত্রীদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলেও তারা সেভাবে ক্যাম্পাসে সক্রিয় রাজনীতি করতে পারেননি।
ওই সময় বহিষ্কার হওয়া একাধিক নেত্রী কালবেলাকে বলেন, কলেজে ছাত্রলীগের আজকের অবস্থানের জন্য সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দায়ী। কারণ যারা সক্রিয় রাজনীতি করত, তাদের প্রায় সবাইকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। অনেকে অভিমানে ছেড়েছেন রাজনীতি। এখন কলেজে ছাত্রলীগের কর্মী সংখ্যা হাতে গোনা। সম্প্রতি কোটা আন্দোলনের প্রাক্কালে কান ধরে ওঠবস করা এক শিক্ষার্থীর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। জানা যায়, তিনি কলেজটির সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী। শাখা ছাত্রলীগের একজন সহসভাপতির বান্ধবী হওয়ায় থাকতেন তার রুমে। ছাত্রলীগের কোনো পদপদবিতে না থাকলেও সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
ওই নেত্রীকে কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা হেনস্তা করেন। কান ধরে ওঠবস করিয়ে মোবাইল ফোনে ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেন সর্বত্র। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি কলেজের বেশিরভাগ সাধারণ শিক্ষার্থী। তারা বলছেন একজন রাজনৈতিক কর্মীর আগে ওই শিক্ষার্থীর পরিচয়, তিনি ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী। এভাবে হেনস্তা করে তার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়াটা কলেজের জন্য অবমাননাকর। সভ্য মানুষ এমন কাজ করতে পারেন না।
এদিকে কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীরাও বলছেন, যারা রাজনীতিতে সক্রিয়, তাদের বেশিরভাগই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানা প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ায়। গুটিকয় রাজনৈতিক কর্মী এর ব্যতিক্রম। কিন্তু কলেজের ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করে এভাবে কোনো শিক্ষার্থীকে অপমান করা হবে, সেটা কারও ভাবনাতেই আসেনি।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, কলেজে শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে বর্তমানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা নেই। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকই সর্বেসর্বা। অন্য যারা সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক গ্রুপ পরিচালনা করতেন তাদের নানাভাবে ক্যাম্পাস ছাড়া করা হয়েছে। এতে কর্মীদের ভালোবাসা দিয়ে কাছে টানার প্রবণতাও কমেছে। সর্বত্র শক্তি দিয়ে দল ভারী করতে চেয়েছেন বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। যার রেশ ধরেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। অনেক ছাত্রলীগ কর্মীও ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের কর্মী সবাই বলছেন, এভাবে হেনস্তা করে তা ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়াটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ইডেন কলেজের ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি। হেনস্তার শিকার ওই নেত্রী আগে এমন কোনো অপরাধ করেননি, যার কারণে তাকে এভাবে অপমান করতে হবে। তারা বলেন, সারা জীবন ওই নেত্রীকে এই হেনস্তা বয়ে বেড়াতে হবে। তিনি এরই মধ্যে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, যা ভালোভাবে নেয়নি কেউ।
জানতে চাইলে কলেজটির শাখা ছাত্রলীগের প্রভাবশালী এক নেত্রী কালবেলাকে বলেন, ‘হামলার আভাস পেয়ে সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সবাইকে হল ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। আর সভাপতি রিভা সবাইকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারা প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই করেননি। তা ছাড়া দুই বছরেরও বেশি সময় পার হলেও তারা এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেননি। আমরা ১০-১২ জন ক্যান্ডিডেট ছাড়া ইডেনে কোনো অ্যাকটিভ কর্মীই নেই। তারা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ।’
ছাত্রলীগ বলছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ইডেনে আসলে ছাত্রফ্রন্টের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে। তবে এই দাবি অস্বীকার করেছেন ইডেন মহিলা কলেজ শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি শাহিনুর সুমি। তিনি বলেন, ‘আমি এখন হলে থাকি না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আমাদের সমর্থন রয়েছে। ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের দখলদারত্ব আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রতিফলন এই হামলা। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছেন।’
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভাকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা কালবেলাকে বলেন, ‘যারা ইডেনে হামলা চালিয়েছে, তারা কেউ সাধারণ শিক্ষার্থী নয়। সবাই ছাত্রফ্রন্ট কিংবা ছাত্রদলের মেয়ে। যারা হামলা চালিয়েছে, তারা কেউ পলিটিক্যাল রুমের মেয়ে নয়। সবাই লিগ্যাল রুমের মেয়ে আর বহিরাগত। লিগ্যাল রুমে সিট দেওয়ার সময় কোনো যাচাই-বাছাই হয় না। এ সুযোগে তারা ঘাপটি মেরে ছিল।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌসী বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘ইডেনে তেমন কোনো ঝামেলা হয়নি। আপনারা যা শুনছেন, ভুল শুনছেন। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি, প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’