প্রতারণার মামলায় দণ্ডিত জয়যাত্রা টিভির চেয়ারম্যান হেলেনা জাহাঙ্গীর আপিলে খালাস পেয়েছেন। এ মামলায় তাকেসহ পাঁচজনকে দুই বছরের সাজা দিয়েছিলেন আদালত। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে তিনি খালাস পান।
২০২১ সালের জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হন হেলেনা জাহাঙ্গীর। পরে তার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয়। এর মধ্যে প্রতারণার মামলায় খালাস ছাড়াও দুটি মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া আরেকটি মামলার বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।
হেলেনা জাহাঙ্গীরের আইনজীবী আব্দুর রব কালবেলাকে বলেন, প্রতারণার মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীর খালাস পেয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের পৃথক দুই মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন। বিচারাধীন অন্য মামলাগুলো থেকেও তিনি খালাস পাবেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীর অব্যাহতি পেয়েছেন। গত ২৫ জানুয়ারি অভিযোগ গঠন শুনানি শেষে ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৫-এর বিচারক তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন। সেই আদেশে বিচারক উল্লেখ করেছেন, ২০২১ সালের ৩০ জুলাই রাতে গুলশানের বাসা থেকে আসামি হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার বাসা থেকে একটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া উদ্ধারের অভিযোগ রয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। আসামির জবানবন্দি, দাখিল করা কাগজপত্রসহ নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, হেলেনা জাহাঙ্গীর একজন ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক। তিনি বিভিন্ন সময় ব্যবসায়িক কাজে বিদেশ ভ্রমণ করেন। অস্ট্রেলিয়ার বিমানবন্দর থেকে শখের বসে একটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া শোপিচ হিসেবে কেনেন। মামলার নথিতে রক্ষিত বিশেষজ্ঞ মতামতে বলা হয়েছে, জব্দ করা আলামতটি কথিত ক্যাঙ্গারুর চামড়া কি না, তা নির্ণয় করা সম্ভবপর নয়। তা ছাড়া সেটি বিদেশ থেকে দেশে চোরাইপথে এনেছে বলে কোনো যৌক্তিক কারণ পরিলক্ষিত হয় না। ফলে আসামি হেলেনা জাহাঙ্গীর অবৈধ, আইনে নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক বা কর ফাঁকি দিয়ে ক্যাঙ্গারুর চামড়া দখলে ও নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন বলে দৃশ্যমান হয়নি। আসামির বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫বি-এর ১(বি) ধারায় অভিযোগ গঠনের পর্যাপ্ত উপাদান পাওয়া যায় না। কাজেই তাকে মামলার অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। একই সঙ্গে ক্যাঙ্গারুর চামড়াটি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এদিকে অভিযোগ গঠনের সুনির্দিষ্ট কোনো উপাদান না থাকায় ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেক মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত অভিযোগ গঠন শুনানি শেষে তাকে অব্যাহতি দেন।
আদেশে বিচারক উল্লেখ করেছেন, আসামি হেলেনা জাহাঙ্গীর সরকারের কোনো মন্ত্রী, কোনো সংস্থা বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেছেন বা কীভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। একইভাবে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮-এর ১৬১ ধারায় সাক্ষীদের দেওয়া জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঘটনার বিষয়ে সাক্ষীরা অনির্দিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। ফরেনসিক পরীক্ষায় ফেসবুক আইডি হেলেনা জাহাঙ্গীরের নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রমাণিত হলেও জব্দ করা স্ক্রিনশটগুলোর কনটেন্ট পর্যালোচনায় উল্লিখিত বক্তব্যগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৫, ২৯ ও ৩১ ধারার অপরাধকে আকর্ষণ করে না। এসব মন্তব্য নিছক রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ বরাবর উপস্থাপিত বক্তব্য মাত্র। এ পরিপ্রেক্ষিতে আসামির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৫, ২৯ ও ৩১ ধারায় অভিযোগ গঠনের সুনির্দিষ্ট কোনো উপাদান নেই বলে প্রতীয়মান হয়। তাই হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
২০২১ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশানের বাসায় অভিযান চালিয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ১৯ বোতল বিদেশি মদ, একটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া, একটি হরিণের চামড়া, দুটি মোবাইল ফোন, ১৯টি চেক বই ও বিদেশি মুদ্রা, দুটি ওয়াকিটকি সেট এবং জুয়া (ক্যাসিনো) খেলার ৪৫৬টি চিপস জব্দ করা হয়। ওই রাতে মিরপুরে জয়যাত্রা টেলিভিশনের কার্যালয়েও অভিযান চালায় র্যাব। বিটিআরসির সহযোগিতায় অনুমোদনহীন জয়যাত্রা টেলিভিশন স্টেশন বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি অবৈধ মালপত্র জব্দ করা হয়। পরে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয়। এসব মামলায় তাকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ। ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে জামিনে মুক্তি পান হেলেনা। পরবর্তী সময়ে প্রতারণার মামলায় গত বছরের ২০ মার্চ ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হেলেনা জাহাঙ্গীরসহ পাঁচজনের দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি ২ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই মাসের সাজা দেওয়া হয়। পরে তিনি আপিলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে এ মামলায় খালাস পেয়েছেন। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ তার মাদকের মামলায় তার বিচার শুরু হয়েছে। এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। আগামী ৩ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে তার আরেকটি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া রাজধানীর পল্লবী থানায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানার উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম আদালতে চার্জশিট জমা দেন। মামলাটি বিচারের জন্য বদলির অপেক্ষায় রয়েছে।