রাজধানীর বাজারে লাফিয়ে বাড়ছে ডিম ও মুরগির দাম। সাধারণত কোরবানির সময় ডিম ও মুরগির দাম কম থাকে; তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। হঠাৎ করে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীরা পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনকে দায়ী করলেও তাদের অভিযোগ অন্যদের বিরুদ্ধে। তারা বলছেন, তেজগাঁও ডিম সমিতি সিন্ডিকেট করে বাড়াচ্ছে ডিম ও মুরগির দাম।
বর্তমান বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম দ্বিগুণ। খামার পর্যায়ে ডিম প্রতি পিস সাড়ে সাত টাকা বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে হয় তেরো টাকা। খামারি পর্যায়ে যে মুরগি ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, তা খুচরা বাজারে ২০০ টাকা। ঈদের সময় কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও ফের ডিম ও মুরগির দাম বাড়ছে।
গতকাল রাজধানীর হাতিরপুল খুচরা বাজারের একটি দোকানে এক হালি ডিম কিনতে চাইলে দোকানি ৫২ টাকা মূল্য দাবি করেন। এ হিসাবে ডজন পড়ে ১৫৬ টাকা। তবে ওই দোকানেই ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকায়। এদিকে খুচরা বাজারগুলোতে ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা। নিউমার্কেট কাঁচাবাজার, নয়াবাজার, হাতিরপুল বাজারসহ কয়েকটি বাজারেও একই দামে ডিম বিক্রি করতে দেখা যায়।
প্রান্তিক পর্যায়ের ডিমের খামারিদের অভিযোগ, যে দামে ডিম ও মুরগি বিক্রি হচ্ছে, এর সুফল তারা ভোগ করছেন না। ডিমের দাম বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ডিম ব্যবসায়ী সমিতির দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন প্রান্তিক খামারিরা। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে বিভিন্ন বাজারের ডিম ব্যবসায়ীরা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে বাড়ছে দাম।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কাপ্তানবাজার। বৃহস্পতিবার ভোরে কাপ্তানবাজার ঘুরে দেখা যায়, দেশের প্রান্তিক অঞ্চল থেকে ট্রাক বোঝাই করে মুরগি ও ডিম আসছে। এ সময় কাপ্তানবাজারের কয়েকজন পাইকারি ডিম ও মুরগি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
পাইকারি ডিম ব্যবসায়ী মেসার্স জহিরুল ট্রেডার্সের ম্যানেজার ওয়াসিম উল্লাহ বলেন, আজকের বাজারে (বৃহস্পতিবার) ডিমের চাহিদার তুলনায় আমদানি কম হলে দাম বাড়বে। আবার চাহিদার তুলনায় আমদানি বেশি হলে দাম কমবে। রাজধানীর বাজারে ডিমের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন, ডিম সমিতি। তারা প্রতিদিন ভোররাতে আমাদের ফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দেয় ওইদিন প্রতি পিস ডিমের দাম কত হবে। এতে আমরা যারা প্রতিদিনই খামারিদের কাছ থেকে ডিম কিনি এবং রাজধানীর বাজারে পাইকারি বিক্রি করি, তাদের কখনো লাভ আবার কখনো লোকসান হয়।
তিনি বলেন, গতকাল (বুধবার) আমার দোকানে ২ লাখ পিস ডিম ঢুকেছে। কিন্তু সব ডিম তো আর এক দিনে বিক্রি করতে পারিনি। গতকাল পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন প্রতি একশ পিস ডিমের দাম নির্ধারণ করেছিল ১ হাজার ১১০ টাকা। আজ (বৃহস্পতিবার) আবার ১০ টাকা কমিয়ে ১ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। গতকাল যে ডিম বিক্রি হয়নি, সেটা আজ ১০ টাকা লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আমরা খামারিদের কাছ থেকে প্রতি পিস সাড়ে সাত টাকা করে কিনি। পরিবহন খরচ ও অন্যান্য খরচ আরও দুই টাকা ধরুন। তারপর কর্মচারীদের বেতন ও দোকান ভাড়া দিয়ে যা থাকে, তা আমাদের লাভ। কিন্তু সবসময় লাভ হয় না। কোনো কোনো সময় লোকসানও গুনতে হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার কালবেলাকে বলেন, আমরা ডিম বা মুরগির দাম নির্ধারণ করি না। মূলত তেজগাঁও ডিম সমিতি সিন্ডিকেট করে ডিম বা মুরগির দাম বাড়ায়। আমরা সরকারকে অনেকবার বলেছি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, কিন্তু নেয়নি।
তবে তেজগাঁও ডিম সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, আমরা ডিমের দাম বাড়াই না, নির্ধারণও করি না। আমরাও সরকারকে বলেছি, যারা ডিমের দাম নির্ধারণ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তবে কারা নির্ধারণ করে, সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি।
কাপ্তানবাজারের আরেক পাইকারি ডিম ব্যবসায়ী মোহম্মদ আলী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী রেজাউল করিম বলেন, এবার কোরবানি হয়েছে মাসের মাঝখানে। মানুষের কাছে টাকা নেই। কোরবানি করতে ঢাকার বেশিরভাগ মানুষই গেছে গ্রামে। সেখানে ব্যয় হয়েছে বেতন-বোনাসের টাকা। তারা এখন ঢাকায় এসেছে, তাদের হাত খালি। মাছ-মাংস না খেয়ে খরচ বাঁচাতে গিয়ে এখন ডিম খাচ্ছে। ফলে ডিমের চাহিদা বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বাড়েনি। ফলে দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, রাজধানীর ডিমের দাম নির্ধারণ করে তেজগাঁও। সেখান থেকে আমরা তাদের নির্ধারিত দামে ডিম কিনি এবং বিক্রি করি। আমরা চাইলেই বাড়তি দামে বা কম দামে ডিম বিক্রি করতে পারি না।
এদিকে কাপ্তানবাজারের পাইকারি মুরগি ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) ব্রয়লার মুরগির পাইকারি দাম কেজি ১৫০-১৬০ টাকা। আমরা খামারিদের কাছ থেকে
১৩০-১৪০ টাকা কেজি দরে কিনে আনি। তবে রাস্তায় ওমুক টোল, তমুক ফি দিতে গিয়ে তো আমরা শেষ। আমরা কাপ্তানবাজারে ট্রাক থেকে মুরগি নামানো
মাত্রই সিটি টোলের নামে ৫০০ টাকার রসিদ ধরিয়ে দেওয়া হবে। এসব খরচ যোগ করে সামান্য লাভ করি আমরা। এর মধ্যেই দিতে হয় দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন।
কাপ্তানবাজারে মুরগি সাপ্লাই দেন ফরিদপুরের খামারি আক্কাস আলী। তিনি বলেন, আমাদের মুরগি ও ডিমের উৎপাদন খরচ বেশি হলেও কম দামে বিক্রি করতে হয় পাইকারদের কাছে। কিন্তু সেই ডিম ও মুরগি আবার ঢাকায় নাকি খুচরা বাজারে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। আমরা কেজিপ্রতি মুরগি ১২০ টাকা বিক্রি করি এবং ডিম প্রতি পিস ৭ টাকা থেকে সাড়ে ৭ টাকায় বিক্রি করি।
এদিকে হাতিরপুল বাজারে বাজার করতে আসা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, দিনকে দিন সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে ডিম ও মুরগির দাম। এখনই দামের লাগাম টেনে না ধরলে, এগুলো কেনা অসম্ভব হয়ে উঠবে। প্রতি বছর কোরবানির আগে ও পরে মুরগি এবং ডিমের দাম কমলেও এ বছর তার ব্যতিক্রম। শুধু দাম বাড়ছেই, কমার কোনো নামগন্ধ নেই।
এদিন রাজধানীর নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে খুচরা ডিম ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা মূলত প্রতি পিস ডিম কিনে আনি ১১-১২ টাকা। পরিবহন খরচ ও অন্যান্য খরচসহ লাভ রেখে ১৩-১৪ টাকায় বিক্রি করছি।
নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের ক্রেতা মোকারম বলেন, ঈদের পর সবজি থেকে শুরু করে মুরগি-ডিম সবকিছুর দাম বেশি। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মাছের বাজারে তো এখন যাওয়া যাচ্ছে না; যে দাম। সেদিক থেকে ডিম ও মুরগির দাম কম। তাই কষ্ট হলেও মুরগি কিনলাম।
হাতিরপুল বাজারের মুরগির খুচরা ব্যবসায়ী মামুন বলেন, আমরা যে পরিমাণ চাহিদা দিই, সেই পরিমাণ মুরগি পাই না। সরবরাহ অনেক কম, আবার দামও বেশি। রাতে যখন কাপ্তানবাজার থেকে মুরগি নিয়ে আসি কয়েকটি জায়গায় পুলিশসহ অনেককে একশ-দুইশ টাকা দিতে হয়। ফলে এই টাকা যুক্ত হয় মুরগির মূল দামের সঙ্গে।