দীর্ঘ ছয় মাসের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষ। এবার দেশের সীমান্ত রক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পালা। কঠোর প্রশিক্ষণের শেষ দিন তাই দৃপ্ত শপথ—‘নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও দেশের সীমান্ত রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকব।’ গতকাল বৃহস্পতিবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৫৫৬ জন নতুন সৈনিক এই শপথ নেন। ‘মনোবল, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা’—বিজিবির এই মূলমন্ত্র চিত্তে ধারণ করে নবীন এই সৈনিকরা সীমান্ত রক্ষায় জীবন বাজি রেখে অর্পিত দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রাঙ্গণ ছাড়েন গতকাল।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জতে অবস্থিত বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজ (বিজিটিসিঅ্যান্ডসি) প্যারেড গ্রাউন্ডে ১০১তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তারা বিজিবির সৈনিক জীবনে প্রবেশ করলেন। এ ব্যাচে ৫২০ জন পুরুষ সৈনিকের পাশাপাশি রয়েছেন ৩৬ নারী সৈনিকও। ১৪ জানুয়ারি বিজিটিসিঅ্যান্ডসিতে এ প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল।
বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নবীন সৈনিকদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন। এ সময় বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও আমন্ত্রিত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সকালে বিজিবি মহাপরিচালককে সশস্ত্র সালাম প্রদানের মধ্য দিয়ে নবীন সৈনিকদের শপথ গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ শেষে বিজিবি মহাপরিচালক নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন।
বিজিবি মহাপরিচালক আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই বাহিনী সাফল্যের পথপরিক্রমায় আজ একটি সুসংগঠিত, চৌকস, সুশৃঙ্খল ও পেশাদার দেশপ্রেমিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে দেশমাতৃকার অখণ্ডতা রক্ষা, সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান ও মাদক পাচার রোধ, নারী ও শিশু পাচারসহ যে কোনো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অসামরিক সহায়তা প্রদান এবং যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বিজিবির ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত।
বিজিবির নানা উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহ পৃষ্ঠপোষকতা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দিকনির্দেশনায় আজ এই বাহিনী একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, অত্যাধুনিক ত্রিমাত্রিক সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিজিবি আজ জল, স্থল ও আকাশপথে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সক্ষম।
নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে মহাপরিচালক বলেন, শৃঙ্খলাই সৈনিকের মূল ভিত্তি। আদেশ ও কর্তব্য পালনে যে কখনো পিছপা হয় না, সে-ই প্রকৃত সৈনিক, বীরযোদ্ধা। সীমান্তে তোমাদের স্মার্ট সৈনিক হিসেবে দেখতে চাই। সীমান্তে তোমরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে, এজন্য কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনৈতিক অর্থ উপার্জন ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে হবে। সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বিজিবি হবে ‘সীমান্তের নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতীক’—এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
বিজিবি মহাপরিচালক ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর বাহিনীর তৃতীয় ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের বিদায়লগ্নে নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণের কথা স্মরণ করে বলেন, জাতির পিতার এই চোরাচালানবিরোধী ও প্রেষণামূলক অমূল্য কথাগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করে তোমাদের দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে ১০১তম রিক্রুট ব্যাচের সব বিষয়ে সেরা চৌকস রিক্রুট হিসেবে প্রথম স্থান অধিকারী মো. মিনহাজ হোসেন রাফি, শারীরিক উৎকর্ষতা (পুরুষ) প্রথম স্থান অধিকারী সিপাহি আবু হুরায়রা এবং সব বিষয়ে তৃতীয় ও শারীরিক উৎকর্ষতা (মহিলা) বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকারী সিপাহি ছাবাতুন উল্লাহ জীম এবং ফায়ারিংয়ে শ্রেষ্ঠ সিপাহি মো. শাহিন উদ্দিনের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। পরে বিজিবির প্রশিক্ষিত সদস্যদের অংশগ্রহণে আকর্ষণীয় ট্রিক ড্রিল এবং বিজিবির সুসজ্জিত বাদক দল মনোজ্ঞ ব্যান্ড ডিসপ্লে প্রদর্শন করে।