নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী। বর্তমানে তিনি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। সরকারি কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কীভাবে এত সম্পদ গড়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এলাকার মানুষ। তবে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও স্বামীর প্রভাবের কারণে অনেকেই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান বর্তমানে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীর দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা। মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী ফেনীর সোনাগাজীর এলাকার শাম্মী আখতার। ‘১৫ লাখ টাকার ছাগলের ভিডিও’ পোস্ট করে আলোচিত মুশফিকুর রহমান ইফাত তার সন্তান।
লায়লা কানিজ লাকী ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ওই চাকরিতে থাকা অবস্থায়ই তিনি রায়পুরা উপজেলার মরজাল এলাকায় প্রায় দেড়শ একর জমিতে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নামের বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ২০১৮ সালে সেখানেই তার সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজীউদ্দিন আহমেদ রাজুর পরিচয় হয়। রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান ২০২৩ সালে মারা যান। ওই পদে উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে লায়লা কানিজ সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। সংসদ সদস্যের প্রভাবে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক।
শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লা কানিজের নামে-বেনামে রয়েছে প্রচুর সম্পদ। নির্বাচনী হলফনামা থেকে জানা গেছে, বার্ষিক আয়ের মধ্যে বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫ এবং ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা আসে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। তার কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ। অকৃষি জমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গা বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, নরসিংদীর রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, যশোরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ এবং নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা বলেন, ‘শিক্ষকতার আয়ে তার এত সম্পদ থাকার কথা নয়। এগুলো তার স্বামী রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের অবৈধ উপার্জন। অবৈধ টাকার জোরেই লায়লা কানিজ লাকী রায়পুরার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।’
মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির আধুনিক স্থাপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি। গত শুক্রবার (২১ জুন) দুপুরে ওই বাড়িতে গেলে ভেতরে ঢুকতে দেননি দায়িত্বে থাকা কেয়ারটেকার। এ সময় তিনি বাড়িটির ছবি তোলা বা ভিডিও করতে নিষেধ করেন।
ফটকের বাইরে থেকে দেখা যায়, কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের বাড়িটি বেশ বিলাসবহুল। আলিশান বাড়ির আলিশান গেট। বাড়ির ভেতরে রয়েছে দেশি-বিদেশি গাছের সারি, সবুজ ঘাসের আঙিনা, পাশে রয়েছে কর্মচারীদের থাকার রুম। বাড়ির ভেতরেই পেছনে রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট ও বিশাল লেক।
স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, বাড়ির ভেতরে রাজকীয় সব আসবাব ও দামি জিনিসপত্র রয়েছে। এ বাড়িতে চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ থাকেন। জমিটি তার পৈতৃক সম্পত্তি। তবে আগে এখানে ভালো কোনো দালান ছিল না। বছর দুই আগে বিলাসবহুল বাড়িটি নির্মাণ করা হয়।’
স্থানীয়রা জানান, লায়লা কানিজের বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন একজন খাদ্য কর্মকর্তা। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে কানিজ সবার বড়। আগে আর্থিক অবস্থা নাজুক ছিল। সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর তার ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
বিমানবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি চাকরি করে এত টাকার মালিক কীভাবে হলেন, তা বোধগম্য নয়। তিনি আমার জমিসহ অনেকের জমি দখল করেছেন। জমি কেনার কথা বলে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে জমি দখলে নেন। বাকি টাকা দেওয়ার পর রেজিস্ট্রি করার কথা থাকলেও তিনি আর কোনো টাকা দেননি। জোর করে জমি দখলে নিয়ে ঢালাই করে পার্কের জন্য ব্যবহার করছেন। আমি জমির কোনো দলিল করে দিইনি, জোরপূর্বক এখন আমার জমি দখল করে রেখেছেন। এ ছাড়া তিনি প্রশাসনিকভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।’
মরজাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সানজিদা সুলতানা নাসিমা বলেন, ‘উনি সরকারি চাকরি করেছেন, উনি সম্মানিত একজন টিচার। এত সম্পদের মালিক হওয়া নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠবে—এটাই স্বাভাবিক।’
রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসাইন বলেন, ‘লায়লা কানিজ টাকার পাহাড় গড়েছেন। রায়পুরার এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর উৎসাহেই রাজনীতিতে এসেছেন তিনি। এমপি প্রভাব খাটিয়ে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। লায়লা কানিজকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের খুব ক্ষতি করেছেন সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ।’