আমি কয়েক দিন আগেই জেনেভা থেকে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরি। আমার সাত দিনের এ জেনেভা সফরের কারণ ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাৎসরিক সভায় যোগদান করা। এর পেছনে অবশ্য একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ ছিল। সেটি হলো, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আমাদের রিজিওনাল ডিরেক্টর। সে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্ষিক সভা ছিল এটি। তাই আমি এ সভায় যেতে নিজেই খুব আগ্রহী ছিলাম এবং শেষ মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে যাই। সেখানে সায়মার সঙ্গে আমার কিছু সময় আলাপও হয়েছিল। তার কার্যকলাপ দেখে আমি মনে করলাম সেখানে যাওয়াটা আমার সার্থক। তার উচ্ছল উপস্থিতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। না হলে এই ৮০ বছর বয়সে এমন ভ্রমণ করতে আমি আগ্রহী থাকি না। কিন্তু এখানে যাওয়ার পর আমার সব কষ্ট সফল হয়েছে, যেহেতু আমি আমার মামণি সায়মাকে দেখতে পেয়েছি এবং আঞ্চলিক নেতা হিসেবে যে এই মুহূর্তে তার কাছে আঞ্চলিক জোটের সব দেশ সমান গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যার জন্য তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে গেছে। অনেকে বলেছিল যেহেতু সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে, তাই হয়তো তার বাংলাদেশের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে; কিন্তু বাস্তবে তার মধ্যে আমি একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পেয়েছি।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে অনেকে মনে করছেন কিছুদিন আগে যে ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল, সেটা তো সমগ্র দেশের ওপর দিয়ে যায়নি। কিছুমাত্র অঞ্চলে প্রভাব ফেলেছে এবং সেখানে প্রতিমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী যখন এই অঞ্চলে গিয়েছিলেন। ’৭০-এর নির্বাচনের সময় দেশে যখন ঘূর্ণিঝড় হয় তখন এরকমই ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও অনেক সময় দেখা গেছে ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করার কারণে খুব কম ক্ষতি হয়েছে। এসব ঝড়ে অবকাঠামোগত ক্ষতি অনেক সময় বিভিন্ন কারণে ঠেকানো সম্ভব হয় না। কিন্তু মানুষের জীবন রক্ষার জন্য বিশ্বে ইতিহাসের অংশ হচ্ছে শেখ হাসিনা তার সরকারকে দিয়ে যেভাবে পরিচালনা করেন, ওইরকম বিশ্বের কোনো দেশ পারে না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও না। এটা প্রমাণিত। আমার কাছে মনে হয়, তার সবকিছুর মূল হচ্ছে তার দর্শন এবং তার এই দর্শনের ওপর ভিত্তি করে এ যে কাজগুলো তিনি করেন, এটা জনগণ মনে করে তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কেউ করে দিচ্ছে।
রিমাল ছাড়াও কিছু রাজনৈতিক ঝড়ও দেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছে সাম্প্রতিক। দেখা গেল সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধানকে যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই নিষেধাজ্ঞা দিল। আবার পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীরের অগাধ ধন-সম্পদের বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে এবং এখনো এটা প্রমাণিত ও কোর্টের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে মিডিয়া ট্রায়াল চলছে। আমার ধারণা অনেক লোক এটি বিশ্বাস করছেন। যদিও এসব বিষয়ে আমরা যত ঢাকঢোল পেটাই, সর্বশেষ যখন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় তখন অনেক সময় এর সঙ্গে মিডিয়া ট্রায়ালের মিল পাওয়া যায় না। আবার এর বিপরীত অবস্থাও হওয়া সম্ভব। তবে এ বিষয়টি যেহেতু এখনো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, তাই এ বিষয়ে কথা বলাটা আমি সমীচীন মনে করি না। কিন্তু যে কারণে এই বিষয়টি আমি উল্লেখ করলাম সেটি হলো, অনেকের ধারণা সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া এমন ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মুদ্রার সাধারণত দুটি পিঠ থাকে। এ নিয়ে কেউ চিন্তা করেছেন কি না, তা আমি জানি না। শেখ হাসিনা তার স্কুলজীবন থেকেই সরাসরি ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তারপর বিয়ে হওয়ার পর সংসার করেছেন এবং এরপর আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি তার পুরো জীবনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি তার বাবা-মায়ের কাছে রাজনীতি শিখেছেন। রাজনীতির অনেক জায়গায় তার অবদান আছে। সুতরাং এই যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এগুলো দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার জন্য ঝড় তো দূরের কথা, কোনো বাতাসও না। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার একটি ব্যাপার। অনেক সময় দেখা যায়, যারা ষড়যন্ত্র করে পরে তাদের কুকীর্তি বের হয়। কিন্তু তার আগে যদি জানা যেত তাহলে হয়তো সে এসব করতে পারত না। এ ছাড়া আজ পর্যন্ত বড় কোনো অর্থনৈতিক বিপর্যয় হওয়ার আগে কেউই বলতে পারেনি এটা করলেই বিপর্যয় বন্ধ হবে। কোনো অর্থনীতিবিদই কোনো বিপর্যয় আগে বুঝতে পারেন না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর থিওরি আবিষ্কার করেন। কিন্তু আগের অর্জন বলে কিছু নেই। কিন্তু এ বিষয়ে শেখ হাসিনা এগিয়ে। তিনি অনেক বিষয় আগেই আন্দাজ করতে পেরেছেন। সেভাবেই তিনি তার সক্ষমতা দেখাতে পেরেছেন এবং বিজয়ী হয়েছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, হেফাজত ইসলাম যখন বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ঢাকা অবরোধ করেছিল তখন শেখ হাসিনা তার বুদ্ধি, বিবেচনা এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপের দ্বারাই সেটাকে বিনা রক্তপাতে প্রতিরোধ করে পুরো দেশ রক্ষা করেছেন। তার প্রত্যেক ইতিহাসই বিজয়ের ইতিহাস।
আমি আমার ছাত্রদের প্রায় সময় বলি ‘Failure is never pillar of success.’ কারণ একটা বিজয় আরেকটা বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। এটা শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন। এ দেশের ১৭ কোটি জনগণ তাকে বিশ্বাস করে। তিনি এ ঘটনাগুলোকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ভেতরে আনবেন। তিনি নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, দুর্নীতির ব্যাপারে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ অবলম্বন করা হবে। এখন তিনি সেই ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ দেখাচ্ছেন। এর কিছু কিছু নমুনা এখন শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনার এ পদক্ষেপের জন্য অনেকে যদি নিজেদের শুধরে নেন, তারা হয়তো বেঁচে যাবেন। আর যারা নিজেদের শুধরে নেবে না অর্থাৎ যাদের ক্ষেত্রে ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনি’ কথাটি প্রযোজ্য তাদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সুতরাং সবাইকে এখন বুঝতে হবে, কাউকে যে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে তার ক্ষমতার দম্ভ দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। দুর্নীতি করলে ছাড় নেই।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। জেনেভায় তার সঙ্গে যখন দেখা হলো তখন তার বিষয়ে একটি কথা মনে হলো। সেটি হলো, সে আগে যেমন মাটির মানুষ ছিল, এখনো তেমনিই আছে। তার ভেতরে সামান্য কোনো গর্ববোধ বা অহংকার নেই। বরং একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে। সে কী কাজ করেছে সে ক্রেডিট বেশি নিতে চাই না। সে সরাসরি সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কাজ করে। কারণ সে জানে, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অনেক বেশি ধারণা আছে এবং অনেক দিনের অভিজ্ঞতা আছে। ডা. সামন্ত লাল সেন যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন তখন সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তার কাজকর্মে সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং সব ক্ষেত্রেই তিনি ভালো কিছু করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বস্তুত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রটা অনেক বৃহৎ। এখানে সবকিছু বুঝে উঠতেই এক বছর সময় লাগে। সে জায়গায় কয়েক মাসের মধ্যেই দারুণভাবে এ ক্ষেত্রটি রপ্ত করেছেন। এর আগে সামন্ত লাল সেন শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন। এজন্যই স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ে একটি ‘ব্যাকগ্রাউন্ড নলেজ’ তার ছিল। আর এজন্যই একজন ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মন্ত্রীর যে অভিজ্ঞতা, সে অভিজ্ঞতা সামন্ত লাল সেন আগেই অর্জন করেছেন। সে অনুযায়ী কাজ তিনি এরই মধ্যে শুরু করেছেন। দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য যে জিনিসটি প্রয়োজন সেই বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে কাজ করছেন।
এবার জলবায়ু ও পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর কথায় আসা যাক। তিনি যে শুধু পরিবেশ বিষয়ে জ্ঞান রাখেন তা নয়। এমনকি স্বাস্থ্য খাতেও তিনি যথেষ্ট ধারণা রাখেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর তা তিনি পালনে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন।
এখানে যে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী কথা উল্লেখ করা হলো, তারা সবাই নেত্রী কী চান তা বুঝেই কাজ করে যাচ্ছেন। সুতরাং বুঝে যারা কাজ করবেন, তারা একরকম ফল পাবেন। অন্যদিকে যারা উল্টোটা করবেন তাদের কী ফল হবে তাও লোকে দেখছে। দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা তার বক্তব্য থেকে একটুও সরে দাঁড়ায়নি। আমরা সারা দিন গলাবাজি করলে যা হয়, তার চেয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা একটি কথা বললেই জনগণ সেটি বিশ্বাস করে। কারণ, তার ক্ষমতার টানা এই ১৫ বছর ৪ মাসে তিনি তার প্রতিটি কথা রেখেছেন।
দেশের ১৭ কোটি মানুষ যেহেতু তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, সেহেতু তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সেভাবেই তিনি দেখবেন এবং সেভাবেই যাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয় সেটা দেখবেন। দেশও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে এবং তিনি যে টাইম ফ্রেম দিয়েছেন তাও ঠিক থাকবে। তাতে কার নামে কী হলো বা কে কী দোষ করল এটাতে কিছুই যায় আসে না। এখানে কো-ইন্সিডেন্ট হতে পারে একজন পুলিশের প্রধান ছিলেন, যিনি দুর্নীতি করেছেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, এটা পুলিশ বিভাগের কোনো দায় নয়। এটা ব্যক্তির দায়। এ ছাড়া ইতিহাস বলে দায়িত্ব নিয়ে সবাই সবসময় ভালো কাজ করে না। কেউ নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে আবার কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। এটা সব সমাজ তথা বিশ্বে ধ্রুব সত্য। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের লোক কোনো অপকর্মে ধরা পড়লে তারা তাদের রক্ষা করে। আর দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা কেউ অন্যায় কাজ করলে তিনি সেখানে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখান। সুতরাং এখানে আর যাই হোক, ইশারায় বা আকার ইঙ্গিতে শুধু শুধু শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ এটি লোকে বিশ্বাসও করবে না এবং এতে দেশেরও কোনো লাভ হবে না।
লেখক: সভাপতি, কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট