জাফর ইকবাল ও হুমায়ুন কবির, সাভার
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৪, ০২:৪৪ এএম
আপডেট : ২২ মে ২০২৪, ০৯:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাবি ঘিরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার অপরাধ সাম্রাজ্য

মাদকের সরবরাহকারী মাসুদ রানা
জাবি ঘিরে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার অপরাধ সাম্রাজ্য

দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক চর্চার উর্বর ভূমি হিসেবেও খ্যাতি আছে প্রতিষ্ঠানটির। তবে বিভিন্ন সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য গণমাধ্যমে শিরোনাম হতে হয়েছে সাতশ একর জায়গার বৃহৎ এ ক্যাম্পাসকে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ক্যাম্পাসে অবাধ মাদকসেবন। নানা গাছগাছালিতে ঠাসা থাকায় মাদকসেবীদের নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছে জাবি ক্যাম্পাস। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠান ঘিরে এবং আশপাশের চারটি এলাকাজুড়ে একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র গড়ে উঠেছে। আর এই অপরাধ সাম্রাজ্যের নেতৃত্বে রয়েছেন সাভারের পাথালিয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই মাসুদ রানাই মূলত জাবি ক্যাম্পাসে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক সরবরাহ করে থাকেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে জাল দলিল তৈরি করে স্থানীয়দের জমি দখল, গণপরিবহন ও বাস কাউন্টার থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনেও মাসুদের নানান অপকর্মের ফিরিস্তি পাওয়া গেছে। ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের এক প্রতিবেদনে মাসুদকে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সিআইডির একটি তদন্তে মাসুদের বিরুদ্ধে জাল দলিল তৈরি করে জমি দখলের প্রমাণ মিলেছে। ওই প্রতিবেদনে মাসুদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশও করা হয়। এসবের পরও অধরাই থেকে যাচ্ছেন মাসুদ রানা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ওয়াহাব আলী নামের এক ব্যক্তির ৪০ শতাংশ জমি জোর করে দখলে নিয়েছেন মাসুদ। এই মুক্তিযোদ্ধার বাসায় হামলা করে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকার মালপত্র লুট করে নিয়ে যায় মাসুদ বাহিনী। এরপর উল্টো এই মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধেই দেওয়া হয় মামলা। ভুক্তভোগী বীর মুক্তিযোদ্ধা জমি ফিরে পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি।

কালবেলাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াহাব আলী বলেন, ‘মাসুদ স্থানীয় অনেক মানুষের ক্ষতি করেছে। আমার জমি এখনো ফিরে পাইনি। বিষয়টি লিখিতভাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও বিচার চাইব।’

মাসুদের ভয়ে পানধোয়া ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ তটস্থ। কেউ তার ‘অবাধ্য’ হলেই নিজের বহুতল ভবনের বেজমেন্টে আটকে রেখে মারধর করা হয়। এমনকি ইয়াবা ধরিয়ে দিয়ে ছবি ও ভিডিও করে রাখা হয় ব্ল্যাকমেইল করার জন্য।

মাসুদ রানার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সাভারের পানধোয়া ইউনিয়ন, আমবাগান, সেনওয়ালীয়া ও গোকুল নগর এলাকা। পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরা দিয়ে ঘেরা। এসব ক্যামেরায় নজরদারি করা হয় মাসুদের বাড়ি থেকে। এসব এলাকার ইন্টারনেট এবং ডিশের ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণও তার। তবে এসব ব্যবসার আড়ালে মাসুদ মূলত ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদকের কারবার করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) মাদকের প্রধান সরবরাহকারী ছিলেন মো. মামুনুর রশিদ মামুন ও মাসুদ রানা। তবে স্বামীকে হলের কক্ষে আটকে রেখে বহিরাগত এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় মামুন গ্রেপ্তার হন। এরপর জাবিতে মাদকের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন মাসুদ রানা।

ক্যাম্পাসে সাধারণত দুই ধরনের মাদক পাওয়া যায়। একটি ‘ছোট মাল’ অন্যটি ‘বড় মাল’ হিসেবে পরিচিত। ছোট মাদক হচ্ছে গাঁজা, যা সর্বত্র পাওয়া যায়। আর ‘বড় মাল’ হলো ইয়াবা, মদ ও ফেনসিডিল। এগুলোর জন্য যেতে হয় ক্যাম্পাসের বাইরে মাসুদের বাড়ি-সংলগ্ন আমবাগানে। আমবাগান থেকেই মাদকের এই পুরো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে মাদকের মূল সাপ্লাইয়ার মাসুদ। তার কাছ থেকে আমাদের স্টুডেন্টরা ক্রয় করে সেবন ও বিক্রি করে। মাদক ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে সব অপকর্মের হোতা এই মাসুদ। জমি দখল, চাঁদাবাজির থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সে করে না। তাকে ২০১৭ সালে একবার র্যাব আটক করেছিল। কয়েকদিন পরই বের হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ক্যাম্পাসের ত্রিসীমানায় মাসুদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। স্থানীয় পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দপ্তরেও মাসুদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’

মাসুদের হয়ে চাঁদা তোলার কাজ করেন আলমগীর, ফরুক ও রিদয় (চাঁদা উত্তোলনের ভিডিও কালবেলার হাতে রয়েছে)। এই তিনজন চাঁদা তুলতে গিয়ে স্থানীয়দের হাতে একাধিকবার আটকও হয়েছেন। দেওয়া হয়েছে পুলিশে। তবে কয়দিন পর বের হয়ে আবারও জড়িয়েছেন একই অপকর্মে।

বিশমাইল থেকে জিরাবো স্ট্যান্ড পর্যন্ত চার হাজারের মতো অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। এসব যানবাহন থেকে দিনে ৩০-১০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। গড়ে ৫০ টাকা ধরলেও চার হাজার যানবাহন থেকে দিনে অন্তত ২ লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলন করে মাসুদের লোকজন। এ ছাড়া পাথালিয়া ইউনিয়নের চারটি গ্রামে কোথাও কোনো স্থাপনা তৈরি করলে আগে মাসুদের বাসায় গিয়ে মোটা অঙ্কের ‘কমিশন’ দিয়ে ছাড়পত্র নিতে হয়। কেউ চাঁদা না দিলে নিজস্ব বাহিনী পাঠিয়ে করা হয় মারধর। বিশমাইলে বিভিন্ন গণপরিবহনের কাউন্টার রয়েছে ৯টি। এসব কাউন্টার থেকে প্রতি মাসে মাসুদকে প্রায় ৪ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মাসুদ রানার সঙ্গে কয়েকদিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি।

জানতে চাইলে সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘তাকে আমরা ধরে চালান দিয়েছি। এরপর সে জামিনে বের হলে তো আমাদের কিছু করার থাকে না। অনেক সময় চালান দেওয়ার পরে সাক্ষী পাওয়া যায় না। এখন আইন তো আইনের গতিতে চলবে, সাক্ষী না পেলে সে জামিন পেয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এক শ্রেণির উকিল মাদক কারবারিদের ছাড়াতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন। আপনাদের উচিত তাদের বিরুদ্ধে লেখা।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমরা কোন ব্যর্থ নির্বাচন চাচ্ছি না : জামায়াত আমির

তোফাজ্জলের খুনিরা যেন রেহাই না পায় : লায়ন ফারুক

ফিলিস্তিন নিয়ে সমন্বয়ক সারজিসের স্ট্যাটাস

ভাইরাল সেই সাইনবোর্ড নিয়ে যা জানা গেল

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক কমিটি বিলুপ্ত

বৃষ্টি নিয়ে সুখবর

গণঅধিকার অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে খুঁটি হিসেবে কাজ করছে

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

‘ভারতকে ছাড়া বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নতি হবে না’

ইসরায়েলকে ছাড় দিচ্ছে না প্রতিরোধ যোদ্ধারা

১০

কয়রায় গণঅধিকার পরিষদের আনন্দ মিছিল 

১১

অবশেষে কমলো সোনার দাম

১২

ভারতে টাইগার রবির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

১৩

যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড় হেলেনের ভয়াবহ তাণ্ডব

১৪

মামলার আসামি হলেই গ্রেপ্তার নয় : আইজিপি

১৫

বৈরুতে বিপাকে বাংলাদেশিরা, দ্রুত সরে যাওয়ার পরামর্শ

১৬

বিএনপি জনগণের ভালোবাসার ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় : নয়ন

১৭

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবি ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের’

১৮

আরব শেখদের লালসার শিকার ভারতের কুমারীরাও!

১৯

বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে গেল ৯৯ টন ইলিশ

২০
X