মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ওয়ালেটের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে অনলাইন জুয়া এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির অর্থ। প্রযুক্তিগত ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা নগদ, বিকাশ, রকেটের মতো এমএফএস প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে অবৈধ অর্থের লেনদেন করছে। এসব লেনদেনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব কর্মকর্তা এবং এজেন্টদের জড়িত থাকার কিছু প্রমাণও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। ধারণা করা হচ্ছে, এমএফএস ব্যবহার করে বছরে অনলাইন জুয়া, ক্যাসিনো এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এর সিংহভাগই পরবর্তীতে পাচার হয় বিদেশে। তাই এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সতর্ক হতে বলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। অন্যদিকে, জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে বেশি বেশি প্রচারের কথা জানিয়েছে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো।
জানা যায়, কয়েক বছর আগেও এসব অবৈধ প্ল্যাটফর্মের লেনদেন হতো শুধু পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে। বর্তমানে গেটওয়ের পাশাপাশি হচ্ছে এমএফএসের মাধ্যমে। কখনো অর্থ লেনদেন হচ্ছে ‘সেন্ড মানি’র মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির কাছে। কখনো হচ্ছে এজেন্টের মাধ্যমে ক্যাশ আউট করে অথবা সরাসরি পেমেন্টের মাধ্যমে। বাংলাদেশে বছরে এসব অবৈধ কার্যক্রমে কী পরিমাণ অর্থের লেনদেন হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব নেই কোনো সংস্থার কাছে। তবে সংশ্লিষ্টদের অনুমান, এর পরিমাণ অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের প্রায় অর্ধেক হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় দেশের বাইরে। এভাবে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই এসব লেনদেনে জড়িত থাকে এমএফএসগুলোর ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার (ডিএসও), ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার (ডিএম) তথা এজেন্টরা। কিছু ক্ষেত্রে এমএফএসগুলোর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও জড়িত থাকতে দেখা গেছে। গত সোমবার কুমিল্লা ও ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে অভিযান চালিয়ে অনলাইন জুয়া ও বিদেশে টাকা পাচার চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তারা হলেন মো. মাহবুবুল আলম (৩০), লোকমান হোসেন ওরফে রায়হান (২৫), মো. হাসিবুর রহমান (২৬) এবং মো. সুমন আলী (২৬)। ওয়ান এক্স বেটের মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে ৩ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে আসছিল এই চক্র। চক্রের সদস্য লোকমান হোসেন ওরফে রায়হান একটি এমএফএস প্রতিষ্ঠানের ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার (ডিএসও)।
এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) রেজাউল মাসুদ কালবেলাকে বলেন, এমএফএসগুলোর কিছু এজেন্ট এ ধরনের লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। অনেকেই এজেন্সি শিপ নিয়ে ডিএসও এবং এজেন্টদের দিয়ে এই নেটওয়ার্কে কাজ করে। লেনদেন যতবেশি হয়, তারা ততবেশি কমিশন পায়। তাদের সুনির্দিষ্ট ডিস্ট্রিবিউশন হাব থাকে। অনুসন্ধানে দেখেছি, এক চীনা চক্র একটি মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে ১৫ দিনে ২৫ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। এক মাসেরও কম সময়ে ওই অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট যে ব্যক্তির নামে খোলা হয়েছিল, সে এই ঘটনার দেড় মাস আগেই মারা গেছে। এমএফএসের মার্চেন্ট ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ওই চায়নিজ চক্রের সঙ্গে জড়িত। তার নাম আবু সায়েম। আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি।
তিনি আরও বলেন, এমএফএসে যেসব অবৈধ লেনদেন হয়, তার একটি বড় অংশ হয় ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য। খিলগাঁও থানার একটি মামলায় (নং-৭১) দেখেছি, ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন হচ্ছে এমএফএসে। মামলাটি মাত্রই অধিগ্রহণ করেছি আমরা। অধিকতর তদন্তের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে অবৈধ লেনদেন পরিচালনা করেন অপরাধীরা। ই-কমার্স প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জুয়েল রানা বলেন, কোনো সাইটে যদি গেটওয়ের মাধ্যমে সরাসরি লেনদেন হয়, তাহলে এমএফএসগুলো দেখতে পাবে টাকা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে। আর তেমনটা হলে গেটওয়ে দেওয়ার আগে সেই সাইটের পক্ষ থেকে বেশকিছু ডকুমেন্ট নেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অপরাধীরা অবৈধ সাইটের ভেতরে একটা বৈধ সাইট লুকিয়ে রাখে। ফলে অর্থ প্রদানকারী বৈধ সাইটে পেমেন্ট করলেও তা ব্যাক-এন্ডে থাকা অবৈধ সাইটের মালিকের কাছে চলে যায়। এটি এমএফএসগুলো ট্র্যাক করতে পারে না। তবে অধিকতর প্রযুক্তি ব্যবহার করলে হয়তো ট্র্যাক করা সম্ভব। কিন্তু সেই প্রযুক্তি বেশ ব্যয়বহুল।
পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান আমার পের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম ইশতিয়াক সরওয়ার বলেন, যখন এমএফএসে কোনো ব্যক্তিগত লেনদেন হয়, তখন সেটি ‘পি-টু-পি’ লেনদেন অর্থ্যাৎ পয়েন্ট টু পয়েন্ট। একটি জায়গা থেকে আরেকটি জায়গায় অর্থ গিয়েছে। এই অর্থ কেন গিয়েছে, কোন লেনদেনের কারণে গিয়েছে, সেটি কিন্তু লেনদেনে লেখা থাকে না। ফলে কোনো গেটওয়ে বা এমএফএস কোম্পানি জানতে পারে না কোন লেনদেন বৈধ আর কোনটা অবৈধ।
গত মাসে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আর্থিক ও অন্য খাত-সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি বৈঠক হয়। এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমরা বৈঠকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম এমএফএসে অবৈধ লেনদেন নিয়ন্ত্রণে মোবাইল সিমে ব্যবহৃত জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এবং এমএফএস অ্যাকাউন্ট চালুর এনআইডি যেন একই হয়। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। যখনই জুয়া বা অন্য কোনো অবৈধ প্ল্যাটফর্মের তথ্য যথাযথ মাধ্যমে পাই, তখনই আমরা ব্যবস্থা নিই। সাইট হলে সেটি বন্ধ করে দিই। আর প্লে স্টোরে থাকা অ্যাপ হলে সে বিষয়েও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, জুয়া এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে লেনদেন অবৈধ। এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। কিছুদিন পরপরই এমন স্ক্যামের খবর পাওয়া যায়। এসব জেনেও ব্যবহারকারীরা এখানে লেনদেন করছেন। তারা লেনদেন না করলে তো কেউ ভুক্তভোগী হয় না।
অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে ব্যবহারকারীদের সচেতন ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো। নগদের হেড অব কমিউনিকেশন্স জাহিদুল ইসলাম বলেন, এসএমএস দেওয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা গ্রাহকদের সচেতনতামূলক বার্তা দিয়ে আসছি। নগদের অ্যাপ নোটিফিকেশনের মাধ্যমেও গ্রাহকদের সতর্ক করে বার্তা দেওয়া হয়, যদিও বিষয়টি বেশ ব্যয়বহুল। তারপরও আমরা তা করছি।
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, নিয়মিত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সব পরিস্থিতিতে সার্বক্ষণিকভাবে এজেন্টদের লেনদেন পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোনো ধরনের সন্দেহজনক লেনদেন পরিলক্ষিত হলে তা সাসপিসিয়াস ট্রানজেকশন রিপোর্টের (এসটিআর) মাধ্যমে বিএফআইইউকে জানানো হয়। পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া লেনদেনের ক্ষেত্রে সরকার প্রদত্ত নিয়ম মেনে চলতে এবং যে কোনো ধরনের অনৈতিক লেনদেন থেকে বিরত থাকতে গ্রাহক ও এজেন্টদের জন্য নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।