ঈদের দুই-তিন দিন আগে ক্যাম্পাস থেকে বাড়িতে ফিরতেন শহীদ আবু সাঈদ। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহযোগিতায় স্থানীয় অসচ্ছল ও নিম্নআয়ের মানুষের ঈদের নতুন কাপড়চোপড় ও সেমাই উপহার দেওয়ার আয়োজন নিয়ে চলত তোড়জোড়। টিউশনির টাকায় বোন ও ভাগ্নিদের কিনে দিতেন নতুন জামা। মাঝে মধ্যে ঈদের উপহার দিতেন পরিবারের সদস্যদের। এ বছর রমজানের শুরু থেকেই ছেলের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন ও মা মনোয়ারা বেগম। তারা জানেন প্রিয় সন্তান আর ফিরবে না। তবুও অপেক্ষা।
কোটা আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ দু’হাত প্রসারিত করে বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেন। খুব কাছাকাছি দূরত্ব থেকে গুলি চালায় পুলিশ, হাসপাতালে নেওয়ার পথেই শহীদ হন তিনি।
শহীদ আবু সাঈদকে ছাড়া পরিবারের এটাই প্রথম ঈদ। শহীদ পরিবারের সদস্যরা স্বজন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি এখনো। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ঈদের আনন্দ। বিষাদ আর স্মৃতিকাতরতায় ফিকে হয়ে গেছে ঈদের রঙ। প্রিয়জন হারিয়ে ঈদের আমেজ মিশেছে বিষাদে।
গত শুক্রবার সকালে পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামে শহীদ আবু সাঈদের বাসায় গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। তার বাবা মকবুল হোসেন তখন মাঠে যাওয়ার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছিলেন। এর আগে তিনি ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় কাটালেন। পাশেই দাঁড়ানো মা মনোয়ারা বেগমের অশ্রুশিক্ত চোখ তখন প্রিয় সন্তানকে খুঁজছিল।
এ সময় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘হামার বাবা রোজার সময় বাড়িত আইসে। একসাথে সেহরি করি, ইফতার করি। এবার আর আইলো না। ঈদের সময় বাড়িত আসি এলাকার মানুষের জন্য সেমাই, চিনি, কাপড়চোপড় কিনি দেয় সংগঠন থাকি। এবার হামার বাবা নাই। কে কিনি দেবে’।
মনোয়ারা বেগম বলেন, আবু সাঈদ বাসায় এলে যেটা খেতে ইচ্ছে করত সেটা বাজার থেকে কিনে আনত। আমরা সবাই মিলে খাইতাম। কিন্তু শান্তশিষ্ট ছেলেকে মেরে ফেলেছে কেন তিনি এখনো চিন্তা করে পান না।
শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, ‘হামার ছইলই তো হারে গেল। হামার আর কীসের ঈদ। এবারের রোজার মাসটা খুব দুঃখজনকভাবে কাটলো’।
ঈদে কেনাকাটা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিনেকাটা করি নাই। আছে সউগ (সব) বাড়িত। আমার ছেলের হত্যায় প্রকৃত দোষীদের শাস্তি চাই। এইটে এখন একমাত্র চাওয়া’। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আবু সাঈদ ছিলেন সবার ছোট। সাঈদের এক ভাই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন, অন্যরা পড়েছেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত। প্রচণ্ড মেধাবী আবু সাঈদ হয়ে উঠেছিলেন পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাশার প্রতীক। তাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছিলেন পুরো পরিবার। তাই নিজে টিউশনি চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন আবু সাঈদ।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর পর শোকে কাতর তার ভাইবোনেরাও। তারা বলছেন, পরিবারের সবার প্রিয় আবু সাঈদকে ছাড়া ঈদের আনন্দ অনুভব করতে পারছেন না।
শহীদ আবু সাঈদের বড়ভাই রমজান আলী বলেন, ২৭ রমজানে এলে একসঙ্গে ইফতারি করতাম। ঈদের দিন বাবাসহ সব ভাইয়েরা মিলে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। যে কয়েকদিন বাড়িতে থাকতো ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিত। ছোট ভাইকে ছাড়া প্রথম ঈদ করব খুবই কষ্ট লাগছে। আব্বা অনেক কান্নাকাটি করছে।
এর আগে গত ২৪ মার্চ শহীদ আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা হস্তান্তর করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এসময় শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন তা গ্রহণ করেন। আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত বছরের ১৮ আগস্ট পুলিশের সাবেক আইজিপিসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী। পরে সম্পূরক এজাহারে আরও সাতজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করেন তিনি। এ মামলায় ৩০-৩৫ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা হয়েছে।
এ মামলাটির তদন্ত করছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) রংপুরের পুলিশ সুপার এবিএম জাকির হোসেন। পরে গত ১৩ মার্চ পিবিআইয়ের কাছে থাকা আলামত জব্দের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আদালত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আলামত জব্দের অনুমতি দেন।
মন্তব্য করুন