পাঁচ বছরের অচলাবস্থার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে জোর প্রস্তুতি চলছে। ভোটের আগে এর গঠনতন্ত্র সংস্কারে বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলো। তার মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা; বিশেষ করে পদাধিকারবলে ডাকসুর সভাপতির পদটি নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে কিছু সংগঠন। এসব নিয়ে খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্র সংস্কার কমিটি। সেখানে ক্ষমতায় ভারসাম্য এনে উপাচার্যকেই সভাপতি হিসেবে রাখার প্রস্তাব দিয়েছে তারা। মানে ডাকসু সভাপতি বা উপাচার্যের একক ক্ষমতা খানিকটা কমছে।
বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, পদাধিকার বলে ঢাবির উপাচার্য সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন। তার হাতে ডাকসু-সংক্রান্ত সব কিছুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এমনকি সভাপতি চাইলে ডাকসুর যে কোনো সিদ্ধান্ত বাতিল এবং পুরো ডাকসুর কমিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করার ক্ষমতাও রাখেন। এ নিয়ম বদলে এ পদে সরাসরি শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত করার প্রস্তাব জানিয়েছিল বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন। তবে উপাচার্যকে সভাপতি রেখে তার ক্ষমতার সীমিত করার প্রস্তাব দিয়েছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, নির্বাহী কমিটির সভায় যে কোনো অ্যাজেন্ডা আলোচনার জন্য সভাপতির অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার এবং তার একক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে সংসদের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া সংশোধন প্রস্তাব বিবেচনা করে একটি খসড়া তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হকের নেতৃত্বাধীন কমিটি। তাদের প্রস্তাবে উপাচার্যকে সভাপতি হিসেবে রাখা হলেও ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন তারা। উপাচার্যকে একক ক্ষমতা না দিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির প্রস্তাবটি উপাচার্যের কাছে জমা দেবেন কমিটির সদস্যরা। আগামী সিন্ডিকেটেই গঠনতন্ত্র সংশোধন প্রস্তাব পাস হবে বলে জানা গেছে।
কিছুটা কমছে উপাচার্যের ক্ষমতা: গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ঢাবির উপাচার্য পদাধিকারবলে সংসদের সভাপতি। প্রস্তাবিত সংশোধিত গঠনতন্ত্রের অন্তত দুটি অনুচ্ছেদে সভাপতির একক কার্যপরিধি বা ক্ষমতা কিছুটা কমানো হয়েছে।
বর্তমান গঠনতন্ত্রের ৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সভাপতি গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত নিয়ম ও প্রবিধান অনুযায়ী সংসদ পরিচালনা নিশ্চিত করবেন এবং জরুরি, অচলাবস্থা বা গঠনতন্ত্র ভঙ্গের মতো পরিস্থিতিতে সংসদের সুষ্ঠু কার্যক্রম নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। সভাপতি সব বিধি বা নিয়মকানুনের ব্যাখ্যা দেবেন এবং তার ব্যাখ্যা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তবে সংশোধিত খসড়ায় সভাপতির নিয়মের ব্যাখ্যা দেওয়া ও তা চূড়ান্ত বলে গণ্য হওয়ার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান গঠনতন্ত্রে সংসদের সর্বোত্তম স্বার্থে সভাপতি যে কোনো সময় নির্বাহী কমিটির যে কোনো পদাধিকারী বা সদস্যকে বরখাস্তের ক্ষমতা রাখেন। পুরো নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন আহ্বান করা বা সংসদ পরিচালনার জন্য অন্য যে কোনো ব্যবস্থা বা সিদ্ধান্ত উপযুক্ত মনে করলে সভাপতি তা নিতে পারবেন। সংশোধিত খসড়ায়ও সভাপতির এসব পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে, তবে তা ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদন সাপেক্ষে’। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সভাপতির এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমছে।
বর্তমান গঠনতন্ত্রের প্রথম অংশের ষষ্ঠ ভাগে পদাধিকারীদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এই অংশের ৬(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্য থেকে কোষাধ্যক্ষ মনোনীত করবেন। প্রস্তাবিত খসড়ায়ও বলা হয়েছে, উপাচার্যই কোষাধ্যক্ষ মনোনীত করবেন, তবে তা তিনি করবেন সংসদের নির্বাহী কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে।
অষ্টমভাগে উল্লিখিত ‘দপ্তর বণ্টন’ অংশের ৮(ত) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন-সংক্রান্ত যে কোনো আপত্তি বা অভিযোগ ফল প্রকাশের তিন কার্যদিবসের মধ্যে সভাপতির কাছে দাখিল করা যাবে এবং এ ক্ষেত্রে সভাপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। বর্তমান গঠনতন্ত্রে বলা আছে, ‘সভাপতির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না।’ তবে এই লাইনটি সংশোধিত খসড়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই কথা বাদ দেওয়া হয়েছে গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের ৬৯ নম্বর অনুচ্ছেদ থেকেও।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের বক্তব্য: বিভিন্ন সংগঠনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ডাকসুর কার্যক্রম পরিচালনায় উপাচার্যের কোনো কার্যনির্বাহী ক্ষমতা থাকতে পারবে না। সব সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে ডাকসুর নির্বাচিত কমিটির হাতে।
ডাকসু নির্বাচনে সভাপতি পদে সরাসরি শিক্ষার্থীদের রাখার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। একই সঙ্গে বর্তমানে কোষাধ্যক্ষ পদে উপাচার্য ক্ষমতাবলে একজনকে নিয়োগ দেন। এ পদেও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ চায় ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত এবং কার্যনির্বাহী কমিটির নিয়মিত নির্বাচন নিশ্চিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৩-এ যথাযথ সংশোধন আনা একান্ত জরুরি বলে মনে করছে ছাত্রদল।
ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, ডাকসুকে কার্যকর করতে হলে গঠনতন্ত্রে সংস্কার দরকার। আর ঢাবির উপাচার্য নির্বাচিত প্রতিনিধি না হয়েও এর অভিভাবক হওয়া স্বৈরতন্ত্রেরই প্রতিচ্ছবি। সভাপতির পদকে সরাসরি ভোটে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্বাচিত করতে হবে। ঢাবির প্রতিটি সিদ্ধান্তে ছাত্র প্রতিনিধির কার্যকর অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
শিবির তাদের সংস্কার প্রস্তাবে উল্লেখ করেছে, যেহেতু সভাপতি পদটি একটি অনির্বাচিত পদ, সুতরাং এর হাত থেকে সব নির্বাহী ক্ষমতা বাতিল করতে হবে। সভাপতি পদটিকে শুধু একটি আলঙ্করিক পদ হিসেবে রাখার প্রস্তাব দেয় সংগঠনটি। ঢাবি শিবির সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ভিসির নির্বাহী ক্ষমতা ছাত্র প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধাগ্রস্ত করে। এজন্য এর সংস্কারটা দরকার। একই সঙ্গে ভিসি বা প্রভোস্টকে একদম বাদ দেওয়ার মাধ্যমেও সমন্বয়টা হয় না। সীমিত ক্ষমতার মধ্য দিয়ে যদি ভিসি কিংবা প্রভোস্ট এই পর্ষদে থাকে, তাহলে প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কলাবোরেশনটা ভালোভাবে হয়।
ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য ছাত্র ফেডারেশন ১৮টি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি পদে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে দায়িত্ব দিতে প্রস্তাব করেন তারা। ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আরমানুল হক বলেন, আমরা নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধির দাবি জানিয়েছি, প্রস্তাব আকারে দিয়েছি। আমরা মনে করছি ডাকসু সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য, এখানে প্রশাসনের সরাসরি ক্ষমতার অংশ হওয়ার সুযোগ নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, আমরা মনে করি উপাচার্য ডাকসুর সভাপতি থাকা উচিত নয়। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের থেকে সভাপতি নির্বাচিত হওয়া উচিত। উপাচার্য থাকলেও তার ক্ষমতা কমিয়ে আনা উচিত।
ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখনো শিক্ষক প্রতিনিধি থাকার প্রয়োজন আছে। কেননা এর মাধ্যমে প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে সংযোগ স্থাপন হয়। সমন্বয় সাধনের জন্য শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। অন্যথায় এককভাবে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ থাকে। উপাচার্য সভাপতি পদে থাকলে অভিভাবকের ভূমিকায় থাকতে পারেন। তবে তাদের ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা যায়। তাদের কার্যক্ষমতা কমিয়ে আনা যায়।
এদিকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের (বাগছাস) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাহিদ আহসান বলেন, জুলাই পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ডাকসুর জন্য ছাত্র সমাজের দাবি জোরালো হয়েছে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, অভ্যুত্থানের সাত মাস পার হলেও ডাকসু নির্বাচনের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও গড়িমসি দেখছি। আমরা আর কোনো টালবাহানা দেখতে চাই না।
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ বলেন, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের সম্মিলিত ডাকসু আন্দোলন ঘোষিত অবস্থান কর্মসূচিতে ভিসি স্যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে তিনি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ, ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ ডাকসুর রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। সে প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখনো অপেক্ষা করছি।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে: বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্র সংস্কার কমিটির সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদ বলেন, ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। এরপর সবকিছু বিবেচনা করে আমরা একটা খসড়া তৈরি করেছি। আমরা বিবেচনা করে দেখেছি উপাচার্য সভাপতি না থাকলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংগতি দেখা দেবে। উপাচার্য সভাপতি হিসেবেই থাকবেন, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সিন্ডিকেট।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, আমাদের কমিটিগুলো পুরোদমে কাজ করছে। আমরা প্রভোস্টদের নিয়ে মিটিং করেছি। অন্য দুই কমিটি ডাকসুর গঠনতন্ত্র নিয়ে বেশকিছু কাজ করছে। তাদের প্রতিবেদনগুলো আগামী সিন্ডিকেটে পাস করানো হবে। এরপর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা ডাকসুর রোডম্যাপ দিতে পারব। আমাদের যেটা পরিকল্পনা, প্রসেস স্লো করব না, সব ডকুমেন্টস হাতে পেলেই আমরা বুঝব কোন সময় ডাকসু নির্বাচন করলে ভালো হয়।
মন্তব্য করুন