বেনাপোল কাস্টম হাউসের শুল্ক কর্মকর্তাদের শতভাগ কায়িক পরীক্ষার পরও ঘোষণার বাইরে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কেজি পণ্য পাওয়া গেছে। বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) কর্তৃক আটক করা ট্রাকের পণ্য চালান ইনভেন্টরি করে এ প্রমাণ মিলেছে। বিষয়টি স্পষ্ট করেছে, বিজিবি আটক না করলে এ বিশাল শুল্ক ফাঁকির ঘটনা আড়ালেই থেকে যেত। সরকারের বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পাশাপাশি, কী ধরনের পণ্য দেশে প্রবেশ করছে, সেটিও অজানা থাকত।
এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। বছরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন শুল্ক-কর বৃদ্ধি করেছে সরকার। ওদিকে দেশের রাজস্ব ঘাটতি এরই মধ্যে ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ ঘাটতি পূরণের দায়িত্বে থাকা শুল্ক কর্মকর্তাদের সামনেই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য চালান খালাস হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্য চালান খালাসের ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এমনকি বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনো মন্তব্য করতেও রাজি হননি তিনি।
বেনাপোল কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, গত ২২ জানুয়ারি বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটের এমআর ইন্টারন্যাশনালের দুটি ট্রাক আটক করে বিজিবি। ট্রাকের পণ্য চালান ইনভেন্টরি করার জন্য বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে বিজিবি, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও শুল্ক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে দেখা যায়, ঘোষণার অতিরিক্ত প্রায় ৬ হাজার ৫২৯ কেজি পণ্য পাওয়া গেছে।
এমআর ইন্টারন্যাশনালের এই পণ্য চালানের মধ্যে নাট-বল্টু ৬ হাজার ৮০ কেজি, স্টার্টার মাইক্রো রিলে ১ হাজার ৫০০ পিস, ট্রাম্পেট জাম্বো ও প্লাস্টিক হর্ন পাইপ ২৪০ কেজি, লং হোস মিউজিক্যাল জাম্বো ১১০ কেজি, বেল্ট পোলি টিলন পাইপ ১৮ দশমিক ৮৯ কেজি এবং গিয়ার সিম সেট সিঙ্গেল মিনার ট্রেলার ২৮ কেজি ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এ চালানটি বেনাপোল কাস্টম হাউসের শুল্ক কর্মকর্তারা শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করেই ছাড়পত্র দিয়েছেন। অর্থাৎ, পণ্যের মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শুল্ক না নিয়েই খালাস করেছেন।
বিজিবি এই চালান আটক না করলে শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি অজানাই থেকে যেত। এদিকে, মিথ্যা ঘোষণার চালানে উচ্চ শুল্কের ক্যান্সারের ওষুধ ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, এ চালানের ব্যাপারে রফাদফা হয়েছে, যার ফলে কাস্টমস কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে শুল্ক ফাঁকির সুযোগ দিয়েছেন। সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান লাবিবা ট্রেড সেন্টারের স্বত্বাধিকারী রাকিব মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্য আমদানির বিষয়টি স্বীকার করলেও ক্যান্সারের ওষুধ থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু এই চালান ধরা পড়ার কারণে শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। প্রশ্ন উঠছে, যেসব চালান শতভাগ কায়িক পরীক্ষা ছাড়াই ছাড়পত্র পাচ্ছে, সেগুলোতে কী পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে? রাজস্ব ফাঁকির আরও একটি পদ্ধতি হলো—দুই হুইলার পার্টসকে তিন বা চার হুইলার পার্টস হিসেবে দেখিয়ে শুল্কায়ন করা, যাতে কম শুল্ক গুনতে হয়। এতে সরকার যেমন বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি কী ধরনের পণ্য দেশে প্রবেশ করছে, তার কোনো নথিও থাকছে না।
এর আগেও বেনাপোল কাস্টম হাউসে একাধিক আলোচিত ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে রয়েছে স্বর্ণ চুরি এবং ভায়াগ্রার চালান আটক। কিন্তু এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরও শুল্ক ফাঁকির অনিয়ম থামছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের শুল্ক নীতির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য হোসেন আহমদ বলেন, ‘কায়িক পরীক্ষায় অনিয়ম পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকলে যথাযথ তদন্ত করা হবে।’ তবে তিনি এটাও দাবি করেন যে, এরই মধ্যে অনেক অভিযোগ ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে, যা বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার একদিকে শুল্ক-কর বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে রাজস্ব আহরণকারী কর্মকর্তাদের নাকের ডগা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার পণ্য ছাড় করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি দেশের আমদানি বাণিজ্যের স্বচ্ছতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
শতভাগ কায়িক পরীক্ষার পরও যদি সাড়ে ৬ হাজার কেজির বেশি অতিরিক্ত পণ্য ধরা না পড়ে, তাহলে শুল্ক কর্মকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে। বিজিবির তৎপরতায় ঘটনাটি ধরা পড়লেও, কাস্টমস কর্মকর্তাদের এই অবহেলার দায় কে নেবে? সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, শুল্ক কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা না হলে ভবিষ্যতে এমন আরও ঘটবে, যা সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরও সংকটে ফেলবে।