এবি ব্যাংকের কাকরাইল ইসলামী ব্যাংকিং শাখার গ্রাহক ‘কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেড’। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৮ লাখ টাকা। অথচ এ প্রতিষ্ঠানকেই ১৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে কোনো সহায়ক জামানত প্রস্তাব করেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। শুধু তা-ই নয়, এবি ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ঋণ প্রস্তাবটি সন্দেহজনক হওয়ায় অনুমোদন থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলেও ব্যাংকের সাবেক এমডি তারিক আফজালের কেরামতিতে দুর্বল এই প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বোর্ডে প্রেরণ করা হয়। যদিও পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে বিতরণ বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সতর্কও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেডে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওই বছরের মার্চে এবি ব্যাংকের কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংকিং শাখায় হিসাব খোলে। এর এক মাসের মাথায় এপ্রিলে ২৫০ কোটি টাকার পরোক্ষ (নন-ফান্ডেড) ঋণ সুবিধার জন্য আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। এই ঋণের অনুমোদনের জন্য কাকরাইল শাখা একই তারিখে কল রিপোর্ট ও তথ্যাদিসহ ইসলামী ব্যাংকিং শাখার বাণিজ্যপ্রধানের কাছে প্রেরণ করলে তা সিদ্ধান্তের জন্য সিআরএম ডিভিশনে পাঠানো হয়।
এরপর ২৮ এপ্রিল শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকল্পের জন্য ২৫০ কোটি টাকার পরোক্ষ ঋণ সুবিধার ন্যায্যতা না থাকায় ১৫০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা প্রদানের অনুরোধ করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো জামানত প্রস্তাব করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক নির্বাহী পরিচালক জামাল উদ্দিনের দৃষ্টিগোচর হলে সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে তিনি ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদন থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। তার পরও এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল ঋণ প্রস্তাবনা পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এটি ব্যাংক ও আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি ও ঋণ প্রস্তাবটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালের ২৮ মার্চ মেসার্স কোয়ালিটি স্টিলের নাম ও মালিকানা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠে কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। নাম পরিবর্তনের আগে ইউসিবি ব্যাংকের মহাখালী শাখা কোয়ালিটি স্টিলের ঋণ ছিল ৬৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এই দায় পুরোটাই এখন কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলসের ঘাড়ে।
প্রস্তাব করা হয়নি জামানত: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলস ২০২৪ সালের ১১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এর কোনো অডিটেড ফাইন্যান্সিয়াল না থাকায় আর্থিক অবস্থার কোনো বিশ্লেষণ পাওয়া যায়নি। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকের সঙ্গে মাত্র ৩ হাজার টাকার লেনদেন করেছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের ব্যক্তিগত তথ্যও বিস্তারিত উল্লেখ নেই।
কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যারা: কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে রয়েছেন কিরণ কুমার কর্মকার। তিনি ২০২৩ সালের আগস্ট মাস থেকে স্যানিটারি ব্যবসায় নিয়োজিত বলে বোর্ডসভার মেমোতে উল্লেখ রয়েছে। আরেক পরিচালক হলেন পলাশ চন্দ্র শীল। উভয় পরিচালক বেসলাইন ইন্ড্রাস্ট্রি লিমিটেডেরও পরিচালক। পলাশ চন্দ্র বিজনেস অপারেশন ম্যানেজমেন্ট ও সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞ। ২০২৪ সালের আগস্টের সিআইবি রিপোর্টে পলাশ চন্দ্র শীলের ব্র্যাক ব্যাংকে ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ঋণ নিম্নমানে খেলাপি হয়। ওই ঋণ গত আগস্টের মধ্যেই সমন্বয়ের কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক বার্তা: গাজীপুরের কালিয়াকৈরে কোয়ালিটি রি-রোলিং মিলসের কারখানার গেটে এবং ভেতরে মেসার্স কোয়ালেটি স্টিল নামে একটি সাইনবোর্ড দেখা যায়। সেখানে থাকা যন্ত্রপাতির বর্তমান সেটআপ শুধু স্কয়ার বার তৈরির জন্য ব্যবহারযোগ্য। বিলেট এই কোম্পানির প্রধান কাঁচামাল, যা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গ্রাহক তার অপারেশনাল কার্যক্রমের জন্য এনওসি গ্রহণ করেনি। এনভায়রনমেন্ট ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন বিভাগের সার্টিফিকেট ইত্যাদি পরিদর্শক দলকে দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া গ্রাহক তার কাগজপত্রে প্রতিদিন ২২০ মেট্রিক টন উৎপাদনের হিসাব দিলেও এই প্রতিষ্ঠান থেকে দিনে সর্বোচ্চ ৩০-৪০ মেট্রিক টন পণ্য উৎপাদন করা যাবে বলেও উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
তারিক আফজাল: এই ঋণ অনুমোদনসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল। তার বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু ঋণে অনিয়ম করার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ডিসেম্বরে তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে কানাডায় পাড়ি জমান। সেখান থেকেই গত ৯ ডিসেম্বর ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির সদস্য। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত এই ব্যাংকার গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর থেকে আর প্রকাশ্যে আসেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এবি ব্যাংকের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ঋণের প্রপোজাল থেকে আমরা এই ঋণ দেওয়ার মতো মনে করেছিলাম। পরে বোর্ড এটি অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠালে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে পর্যবেক্ষণ দেয়। এজন্য ঋণ আর অ্যাপ্রুভ হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের নিষেধের পরও ঋণটি কীভাবে বোর্ড পর্যন্ত গেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো ব্যাপার না। ব্যাপার হচ্ছে ঋণটি অ্যাপ্রুভ হয়েছে কি না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা কালবেলাকে বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না, জানা নেই। তবে যদি ঘটে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পরিদর্শন করে দায়ী ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।