ধান সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ২০২১ সালে দেশের বিভিন্ন জেলায় সাইলো নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। এজন্য একটি প্রকল্পের আওতায় ৩০টি সাইলো নির্মাণের কথা ছিল খাদ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও কোনো কাজ শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি। তাই বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাস্তবসম্মত না হওয়ায় কাজ না করেই প্রকল্পটি শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নির্মাণকাজ শুরু না হলেও প্রকল্পটি চলেছে সাড়ে তিন বছর ধরে। এ সময়ের মধ্যে নির্মাণ তো দূরের কথা, জমি অধিগ্রহণও করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। ঘুরেফিরে আর পরামর্শকের কাছ থেকে পরামর্শ নিতেই শেষ হয়ে গেছে প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ। অথচ কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা আপ্যায়ন এবং গাড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি এবং পরামর্শে খরচ হয়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ কোনো কাজ না হলেও গচ্চা গেছে জনগণের করের এই টাকা।
এমন ঘটনা ঘটেছে খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান শুকানো, সংরক্ষণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ আধুনিক ধানের সাইলো নির্মাণ প্রকল্পে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথম ৩০টি সাইলো নির্মাণের জন্য ২০২১ সালে এটি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। খরচ ধরা হয় ১ হাজার ৪০০ কোটি ২১ লাখ টাকা। আড়াই বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
নির্ধারিত মেয়াদে শেষ করতে না পারায় এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি ১৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে প্রথমবার সংশোধন করা হয়। প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু বর্ধিত মেয়াদেও কোনো কাজ শুরু করতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর। তাই আরও দুই বছর মেয়াদ বাড়াতে এবং প্রকল্পের কার্যক্রম কমাতে প্রকল্পটি দ্বিতীয়বার সংশোধনের প্রস্তাব করে সংস্থাটি।
তবে প্রকল্পটির মেয়াদ না বাড়িয়ে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত বছরের শেষ দিকে পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি আলোচ্য প্রকল্পটির কাজ অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করার জন্য প্রস্তাব করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় থেকে ১ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা কমিয়ে ব্যয় ধরা হয় ৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা এবং মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা প্রকল্পটির আওতায় কোনো কাজ না হলেও খরচ হয়ে গেছে ৬ কোটি ৩০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে পরামর্শকের পেছনে খরচ ৩ কোটি ৯৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা, কর্মকর্তাদের ঘুরাফেরার জন্য দুটি গাড়ি ভাড়া এবং যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ১ কোটি ১০ লাখ ৫৩ হাজার টাকা, কর্মকর্তাদের বেতন, ভ্রমণ এবং বাড়ি ভাড়া ও নানা রকম ভাতা বাবদ ৮০ লাখ টাকা এবং আউটসোর্সিং জনবলের পেছনে খরচ হয়েছে ২৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া টেলিফোন বিল, প্রচার-প্রচারণা, স্থানীয় প্রশিক্ষণ অফিস ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জমাদিতে খরচ বাকি ২২ লাখ ৬১ হাজার টাকা।
প্রকল্প পরিচালক ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল আলম বলেন, প্রকল্পটি নতুন হওয়ায় এবং পরামর্শক সংস্থা নিয়োগে বিলম্ব হওয়ায় মাঠপর্যায়ে প্রকল্পের কার্যক্রম করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পটি নেওয়ার সময় যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন বাস্তবসম্মত না হওয়ায় সমাপ্ত করা হয়েছে। এতে কিছু টাকা খরচ হলেও দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার চেয়ে ভালো।
পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মো. মামুন আল রশীদ কালবেলাকে বলেন, মন্ত্রণালয়গুলোয় প্রকল্প নেওয়ার জন্য একটা প্রতিযোগিতা থাকে। সেই প্রতিযোগিতা থেকে সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রকল্প নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সেক্ষেত্রে অনেক ত্রুটি থাকে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং এ ধরনের প্রকল্প শুধু বাদ দিলে হবে না, সাইলো নির্মাণের জন্য জায়গা চিহ্নিত না করে প্রকল্প নেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থা না নিলে এ প্রবণতা বন্ধ হবে না।