দেশের চার গ্যাসক্ষেত্রের চারটি কূপে প্রথমবারের মতো ডিপ ড্রিলিংয়ে (গভীর কূপ খনন) যাচ্ছে সরকার। গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে গ্যাসক্ষেত্রের অধিক গভীরতায় কী রয়েছে, তা জানা যাবে। পাশাপাশি গ্যাসের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তবে ডিপ ড্রিলিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পেট্রোবাংলার অধীন অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোর কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা নেই। এ জন্য অভিজ্ঞ কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাতে এরই মধ্যে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
এদিকে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিজ্ঞতা না থাকলেও বাংলাদেশের ডিপ ড্রিলিংয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এখন ডিপ ড্রিলিংয়ের জন্য অনেক অভিজ্ঞ কোম্পানি রয়েছে। তাদের কন্ট্রাক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েও এই কাজ করানো যায়। দেশে যে গভীরতায় গ্যাস কূপ খনন করা হয়, এর নিচেও গ্যাসের স্তর থাকতে পারে। একমাত্র ডিপ ড্রিলিংয়ে তা জানা সম্ভব।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, আমরা জানি না দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর অধিক গভীরতায় কী আছে। কয়েকটি কূপে অধিক গভীরতায় বড় গ্যাসের স্তর রয়েছে ধারণা করা হচ্ছে। তাই আমরা চারটি কূপে ডিপ ড্রিলিং করে দেখতে চাই। এ জন্য দরপত্রও আহ্বান করেছি।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ডিপ ড্রিলিং করতে সম্ভাবনাময় শ্রীকাইল ডিপ-১, মোবারকপুর ডিপ-১, তিতাস-৩১ ডিপ এবং বাখরাবাদ-১১ ডিপ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে শ্রীকাইল ও মোবারকপুরে ডিপ ড্রিলিংয়ের কাজ করবে বাপেক্স এবং তিতাস ও বাখরাবাদে কাজ করবে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। ডিপ ড্রিলিংয়ের কাজ করতে ২৭ আগস্ট উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করেছে পেট্রোবাংলা। আগামী ১৮ ডিসেম্বর দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময়।
জানা গেছে, বাপেক্স যে দুটি কূপে ডিপ ড্রিলিং করবে ওই দুটি কূপ খনন করা হবে ৫ হাজার ৫০০ মিটার থেকে ৬ হাজার মিটার গভীরতায়। অন্যদিকে, বাখরাবাদে দুটি কূপ খনন করবে ৫ হাজার ৪০০ থেকে ৬ হাজার মিটার গভীরতায়। দেশে সাধারণত ২ হাজার ৬০০ মিটার থেকে ৪ হাজার মিটার পর্যন্ত কূপ খনন করে গ্যাস তোলা হয়। তবে ফেঞ্চুগঞ্জ-২সহ কিছু কূপে ৪ হাজার ৯০০ মিটার পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। ফলও ভালো পাওয়া গেছে।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, ডিপার জোনে আমাদের কোনো কাজ নেই। যে চারটি কূপ ডিপ ড্রিলিং করা হবে, সেখানে এরই মধ্যে ত্রিমাত্রিক জরিপ করা হয়েছে। জরিপে গ্যাসের নতুন স্তর পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন কূপের গভীরতা এবং অতিউচ্চচাপ আমলে নিয়েই কাজটি করা হবে।
তিনি বলেন, ডিপ ড্রিলিংয়ের জন্য এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আমরা কন্ট্রাক্টর দিয়ে কাজ করাব। কারণ এ বিষয়ে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমরা সফল হলে, গ্যাস খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিপ ড্রিলিংয়ে বেশ কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। সাধারণত সাড়ে ৪ হাজার মিটার নিচে হার্ড রক থাকে। এরপর থাকে গলিত লাভা। তবে শ্রীকাইল, মোবারকপুর ও তিতাসের ওই অংশে কী আছে, তা এখনো কেউ জানে না। হার্ড রক ভেদ করে ড্রিলিং করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া সম্ভব।
সংগত কারণে বলা হচ্ছে—এখানে যেমন রিস্ক আছে, তেমনি সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে বাপেক্সের ত্রিমাত্রিক জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে, অধিক গভীরতায় গ্যাস থাকতে পারে।
ওই জরিপে বলা হয়েছে, শ্রীকাইলে ৯২৬ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) আর তিতাসে ১ হাজার ৫৮৩ বিসিএফ গ্যাস থাকতে পারে। সব মিলিয়ে মজুতের পরিমাণ আড়াই টিসিএফের (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) মতো হতে পারে। বিজিএফসিএলের দুটি কূপেও একই সম্ভাবনা রয়েছে।
জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের ডিপ ড্রিলিংয়ে যাওয়া উচিত। এখন বিশ্বে ডিপ ড্রিলিংয়ের কন্ট্রাক্টর পাওয়া যায়। বাপেক্স ও বিজিএফসিএলের তত্ত্বাবধানে খননের কাজ সম্পন্ন করে দেবে।
তিনি বলেন, এখন আমাদের স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে। ২৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে কমে এখন ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট হয়েছে। পেট্রোবাংলার এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, স্থানীয় উৎপাদন ধরে রাখা এবং কমতে না দেওয়া। কমলে আমাদের উচ্চ দামের এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাবে। তাই ডিপ ড্রিলিং হোক, আর ড্রিলিং হোক, সবই করতে হবে।
উল্লেখ্য, স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ২০২৬-২৮ সালের মধ্যে স্থলভাগে ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা পেট্রোবাংলার। এই ১০০ কূপের মধ্যে ৬৯টি অনুসন্ধান কূপ। বাকি ৩১টি বিদ্যমান কূপের ওয়ার্কওভার করা হবে। এর মধ্যে ৬৮ কূপ খননের মাধ্যমে বাপেক্স জাতীয় গ্রিডে ২০২৮ সাল নাগাদ দৈনিক আরও ১৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করতে চায়। বাকি ৩২ কূপের মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (বিজিএফসিএল) খনন করবে ২১টি কূপ। এর মধ্যে অনুসন্ধান কূপ ৯টি ও ওয়ার্কওভার কূপ ১২টি। এর মাধ্যমে দৈনিক ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যোগ করা পরিকল্পনা রয়েছে। আর ১১ কূপ খনন করবে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)। এর মধ্যে অনুসন্ধান কূপ ৮টি এবং ওয়ার্কওভার কূপ তিনটি। এই ১১ কূপ থেকে ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে।