আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়ম লঙ্ঘন করে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি (ডিপিসি) গঠন ছাড়াই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের কর্মচারীদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা করা হয়েছিল। এ তালিকায় বিভিন্ন অনিয়মে অভিযুক্তদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কালো তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উচ্চশিক্ষার সনদ গ্রহণ করা কর্মচারীরাও আছেন। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ আমলে অর্থের বিনিময়ে একটি সিন্ডিকেট এ তালিকা করেছিল। সেই তালিকা ধরেই এখন পদোন্নতি দেওয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ১৪ জন কর্মচারীকে মাউশির প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদে ৮৬ জন কর্মচারীকে পদোন্নতি দিতে তোড়জোড় চলছে। এই সুপারিশ এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মাউশির আওতাধীন ১৩তম ও ১৪তম গ্রেডের কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৩শ। কিন্তু স্থায়ী কোনো জ্যেষ্ঠতার তালিকা নেই। এর ফলে দুটি জ্যেষ্ঠতার তালিকা করা হয়েছে। একটি তালিকায় ১৮৫ জন এবং অন্য তালিকায় রয়েছে ২৫৬ জনের নাম। আবার কোনো কর্মচারীর নাম একাধিক তালিকায় রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা-২০১১ অনুযায়ী সমন্বিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা থাকার কথা থাকলেও মাউশি থেকে সেটি না করে ২০২১ সালে ২ ডিসেম্বরের এক অফিস আদেশ অনুযায়ী অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখা থেকে ফিডার পদধারীদের আবেদন চাওয়া হয়। আদেশ অনুযায়ী পদোন্নতির জন্য তথ্য দেওয়া আংশিক কর্মচারীদের নিয়ে একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এটাকেই জ্যেষ্ঠতার তালিকা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার ২০২১ সালের তালিকা দিয়ে ২০২৪ সালে পদোন্নতি দিতে যাচ্ছে মাউশি। মেধা তালিকা না থাকলে পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতা বয়সের জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। বয়স একই হলে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের শিক্ষাবর্ষের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। তবে কর্মচারীদের পদোন্নতির তালিকা করা হয়েছে মেধাকে পাশ কাটিয়ে, যোগদানের তারিখ ধরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত ৭ ফেব্রুয়ারি তারিখের এক আদেশ অনুযায়ী, পদোন্নতির জন্য ডিপিসি বাধ্যতামূলক করে একটি কমিটি করা রয়েছে। কিন্তু গত ২৩ সেপ্টেম্বর ডিপিসি ছাড়াই ১৪ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
সূত্র বলছে, পদোন্নতির তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সনদ ইউজিসির কালো তালিকাভুক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এসব সনদ দিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও পর্যন্ত করা যায় না। অথচ একই সনদ দিয়ে কর্মকর্তা হয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও যাচাই করবেন তারা। আবার বিএড বা মাস্টার্সের যেসব অনুমতিপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই জাল।
সূত্র আরও বলছে, শিক্ষা ছুটি ছাড়া নিয়মিত কোর্সে বিএড বা মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন, অনুমতির স্ক্যান কপি জমা দেওয়া, স্নাতকে তৃতীয় বিভাগ থাকলেও স্ক্যান করে দ্বিতীয় বিভাগ দেখানো, ইউজিসির কালো তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা হয়েছে মর্মে সনদ জমা, চাকরিতে যোগদানের পর অনার্স করা, এক জেলায় চাকরি করেও অন্য জেলার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ও মাস্টার্স সনদ অর্জনের সনদ দেখানোর অভিযোগ রয়েছে এসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে।
সূত্র জানিয়েছে, ‘সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা’ পদে পদোন্নতি পেতে বিএড ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। আর ডিগ্রিতে তৃতীয় শ্রেণি থাকলে তার মাস্টার্স ডিগ্রি থাকতে হবে। তবে অনেকেই দ্রুত সনদ নিতে চাওয়ায় সিন্ডিকেট অর্থ বাণিজ্যের সুযোগ পায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাউশির একটি সিন্ডিকেট পদোন্নতি ও বদলির পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন নরসিংদীর পলাশ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের হিসাব রক্ষক মো. বেল্লাল হোসেন এবং ঢাকার দারুল সালাম উচ্চ বিদ্যালয়ের উচ্চমান সহকারী নজমুল হোসেনসহ কয়েকজন। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক দুই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও দীপু মনি এবং দীপু মনির অনুসারী অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। এসব কর্মচারী পদোন্নতির জন্য কয়েক কোটি টাকার একটি তহবিল সংগ্রহ করেছেন। এই টাকার ভাগ গেছে পিএসসির একজন কর্মকর্তা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি গ্রুপের কাছে। বাকি টাকা গেছে সিন্ডিকেট সদস্যদের পকেটে।
সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মো. বেল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে মাউশির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস এবং নজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে এনটিআরসিএর সনদ জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে দুদকের তদন্ত চলমান রয়েছে। দুজনের বিরুদ্ধেই শিক্ষা ছুটি ছাড়া ইউজিসির কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষার সনদ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিগত সময়ে কালবেলাসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগ ওঠার পরে বেল্লালকে মাউশি থেকে নরসিংদীতে এবং নজমুলকে ঢাকার দারুল সালাম উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়।
এর মধ্যে বেল্লাল বদলি হলেও অফিসে অনিয়মিত। বছরের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন মাউশি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নরসিংদীর পলাশ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিলন কৃষ্ণ হালদার কালবেলাকে বলেন, অনুপস্থিতির কারণে তার (বেল্লাল হোসেন) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে মাউশির কর্মকর্তারা বলেন, তাকে আমরাই বিভিন্ন কমিটিতে রেখেছি। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তখন তো আমার কিছু করার থাকে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো. শাহজাহান কালবেলাকে বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো পদোন্নতি হবে না, এটা আমাদের সাফ কথা। এই পদোন্নতির ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য হবে।
মাউশির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম বলেন, আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি, যারা পদোন্নতির বিষয়টি যাচাই-বাছাই করছে। সবার তথ্যই যাচাই-বাছাই করা হবে। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।
এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।