২০২১ সালের ঘটনা। বাল্যবিয়ের কারণে হুমকিতে পড়ে সাতক্ষীরায় আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর জীবন। সেবার ৬৭ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়। আলীপুর ইউনিয়নের ওই ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর পরপরই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিয়ে নানা কর্মসূচি হাতে নেয় প্রশাসন ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো। সংশ্লিষ্টদের দাবী, বাল্য়বিয়ে মেয়েদের সুরক্ষা দেয় না। বরং কেড়ে নেয় শৈশব আর এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ। মহামারির মতো হুমকিতে ফেলে তার জীবনকে।
জেলা সদরের ভোমরা ইউনিয়নের মরিয়ম সুলতানা (আসল নাম নয়)। কয়েক মাস আগে তারও লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। মাত্র ১২ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছিলেন তার বাবা। সেজন্য দিনক্ষণও ধার্য করা হয়। চলতি বছর ২৩ আগস্ট বিয়ের কথা ছিল। গোপনে চলছিল প্রস্তুতিও। কিন্তু বিয়ের ৫ দিন আগে বিষয়টি জানতে পারেন ভোমরা ইউনিয়ন শিশু ফোরামের সদস্য সেতু সুলতানা। সঙ্গে সঙ্গে জানান ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের ম্যানেজার প্রোগাম মো. শরিফুল ইসলামকে। বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পান বৈচনা গ্রামের পল্লীশ্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
মো. শরিফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, দেরি না করে মেয়েটির স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বিষয়টি জানাই। তিনি ছাত্রীর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ঘটনা সত্যি। এরপর প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ের প্যাডে মেয়ের বাবার কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়ার অনুরোধ করি। অন্যদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি ও শিশু সুরক্ষা কমিটি এবং ইউনিয়ন পরিষদকেও জানাই। পরদিন ১৯ আগস্ট সবাই মরিয়মের বাড়িতে যান।
ভুক্তভোগীর দিনমজুর বাবা অপকটে স্বীকার করেন সেই ঘটনার কথা। তিনি জানান, ৬ জনের সংসার একার আয়ে চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আক্ষেপ করে বলেন, এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। ভালো ছেলে পাওয়ায় মেজ মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছি। তাছাড়া ওর লেখাপড়া খরচ চালানোও কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই বাল্যবিয়ে বন্ধে ভূমিকা রাখেন বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সাকিবুর রহমান বাবলাও। তিনি ওর বাবাকে বোঝান, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া দন্ডনীয়। এটা করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।
এদিকে মরিয়ম নিজেও বিয়েতে রাজি ছিল না। সে জানায়, লেখাপড়া করতে চাই, বিয়ে নয়। এ কথা শুনে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধি এবং প্রধান শিক্ষক তার পড়ার খরচ বহনের প্রতিশ্রুতি দেন। পাশপাশি তার বাবার কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয় যে, ১৮ বছরের আগে মরিয়মের বিয়ে দেওয়া যাবে না। সেরকম চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে ভোমরা ইউপি চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল গাজী বলেন, আমার ইউনিয়নে যাতে একটি বাল্যবিয়েও না হয়, সেজন্য চৌকিদারি দিয়ে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। কোনো অভিভাবক দারিদ্রতার কারণেও এমন পদক্ষেপ নিলে তা বন্ধের ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সহপাঠীরা আরেকটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে সাতক্ষীরায়। পৌরসভার বাটকেখালির কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী সুমনা আক্তার (আসল নাম নয়)। তার অমতেই অভিভাবকরা বিয়ে দিচ্ছিল।
সাতক্ষীরা পৌরসভার ইয়ূথ ফোরামের সদস্য হৃদয় মন্ডল গেল ২৩ জুন বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স সাতক্ষীরা প্রকল্প অফিসের কমিউনিটি সোশ্যাল ওয়ার্কার মো. আব্দুল মান্নানকে ঘটনাটি জানান।
আব্দুল মান্নান কালবেলাকে বলেন, ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স; এর ম্যানেজার প্রোগাম মোঃ শরিফুল ইসলাম, জেলা ও উপজেলা; জেলা প্রশাসন এবং জেলা বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটিকে জানাই। তাদের প্রতিনিধিরা বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে মেয়ের বাড়িতে যান। এ সময় পালিয়ে যায় বরপক্ষ।
১৪ বছরের সুমনা আক্তার জানায়, রাজি ছিলাম না, তাও বাবা জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল। স্কুলে যাওয়ার পথে এক বখাটে প্রতিনিয়ত বিরক্ত করত। বাড়িতে তা জানালে নিরাপত্তার কথা ভেবে স্কুলে যেতে বারণ করেন বাবা। পরে আমার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে বিয়ে ঠিক করেন।
মরিয়ম ও সুমনার মতো এমন ৮৭টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছে ব্রেকিং দ্য লাইসেন্সের সাতক্ষীরা শিশু সুরক্ষা নেটওয়ার্কের সদস্যরা। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এগুলো করা হয়েছে।
তবে, প্রাথমিকভাবে বন্ধ হলেও পরবর্তীতে আবার বিয়েও হয়ে যাচ্ছে অনেকের। প্রশাসনের মনিটরিংয়ের অভাবে এটি হচ্ছে বলে মনে করেন ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি’র সদস্য সাকিবুর রহমান বাবলা। তিনি জানান, ২০১৩ থেকে ৮শ’র মতো বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। তবে পরবর্তী প্রশাসনিক মনিটরিং নেই। তাছাড়া কমিটির সদস্যদের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। এরপরও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শিশু ও ইয়ূথ ফোরামের সদস্যদের সচেতনতার কারণে বেশকিছু বিয়ে বন্ধ হয়েছে। বাবলা বলেন, সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আর্থিক জরিমানার ক্ষমতায়ন করতে পারলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও কার্যকরী হতো। এক্ষেত্রে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নিয়মিত পাঠাতে হবে। যাতে কারণ যাচাই-বাছাই করে দ্রুত ব্যবস্থা্ নেওয়া যায়।
ইউএনও শোয়াইব আহমাদ বলেন, গেল ৫ আগস্টের পর হঠাৎ করে বাল্যবিয়ে কিছুটা বেড়ে যায়। সীমান্ত এলাকা হওয়ার কারণে প্রান্তিক পরিবারের পাশপাশি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাও বাল্যবিয়ের শিকার। পাচার হওয়ার আশংকায় অনেক অভিভাবক কম বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিতে চায়। এছাড়া সামাজিক ট্যাবু থেকেও এটি হয়। তিনি আরো বলেন, তবে বাল্যবিয়ে এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সক্রিয়তায় ঘটনার আগেই খবর পাচ্ছি। সহপাঠীরাও এগিয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে আজ শনিবার পালন করা হবে বাল্যবিবাহ নিরোধ দিবস। এ উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।