ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ছাত্রলীগের। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাসেও ছিল সেই প্রভাব। এই আধিপত্যের জেরেই ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাস সংলগ্ন দোকানপাটে চাঁদাবাজি, বাকি খেয়ে টাকা পরিশোধ না করাসহ নানাবিধ অপকর্ম করেছে তারা।
জানা গেছে, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ও এর আশপাশের বিভিন্ন দোকান ও হোটেলে চাঁদাবাজি করতেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শুধু চাঁদাবাজিই নয়, দল বেঁধে গিয়ে খেয়ে টাকা পরিশোধ না করারও নজির রয়েছে। জবির টিএসসি ও ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়া মিলিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাকি খাওয়ার পরিমাণ ১৫ লাখ টাকার বেশি। সম্প্রতি কালবেলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব চিত্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জবির টিএসসি সংলগ্ন আরামবাগ হোটেলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীর কাছে অন্তত ৫ লাখ টাকা বাকি। এর মধ্যে সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী মেহেদীর কাছে অন্তত ১ লাখ ও মিরাজের কাছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। এ ছাড়া টিএসসির চায়ের দোকান থেকেও বাকি খেয়ে টাকা পরিশোধ করতেন না তারা। টিএসসির খোকন মামার চায়ের দোকান থেকে বাকি খেয়ে বিল পরিশোধ করেননি অনেকেই। এই দোকানি জানান, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে ১ লাখ টাকার বেশি বাকি পড়ে রয়েছে।
টিএসসির ভাতের হোটেলেও দেখা যায় একই চিত্র। আনোয়ারের ভাতের হোটেল থেকে বাকি খেয়ে বিল দিতেন না শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেনের অনুসারীরা। সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী মিরাজের নির্দেশে বাকি খেতেন কর্মীরা। এই দোকানি জানান, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কর্মীরা ১ লাখ টাকার বেশি বাকি খেয়েছেন।
এ ছাড়া টিএসসির শিঙাড়া-সমুচার দোকানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাকি খাওয়ার হিসাবই নেই। দোকানিরা বলেন, প্রতিদিন ছেলেরা আসত, খেত, টাকা না দিয়ে চলে যেত। টাকা চাইলে গালাগাল করত। বিশেষত সভাপতি প্যানেলের রবি এবং মেহেদীর লোকজন প্রতিদিন অন্তত ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকার বাকি খেত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ক্যাফেটেরিয়া থেকে গত দুই বছরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ৭ লাখ টাকার মতো বাকি খেয়েছেন। পরে আর টাকা দেননি। এখন তাদের সবাই পলাতক। ক্যাম্পাসে আসেন না। ক্যাফেটেরিয়া সূত্র জানায়, জবির ক্যাফেটেরিয়ায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজির নামে বাকি রয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম আকতার হোসেনের নামে বাকি রয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া ক্যাফেটেরিয়াতে বাকির হিসাবে নাম রয়েছে ছাত্রলীগের আরও অন্তত পাঁচ নেতাকর্মীর। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির ‘মাই ম্যান’ খ্যাত রবিউল ইসলাম রবির নামে বাকি ৫২ হাজার টাকা। সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেনের ‘গ্রুপ লিডার’ খ্যাত মিরাজের নামে বাকি রয়েছে ৭৫ হাজার টাকা, সহসভাপতি মেহেদী হাসান বাবুর নামে বাকি ৫৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে ক্যাম্পাস সংলগ্ন আরামবাগ
হোটেলের মালিক আবু লাল মিয়া বলেন, ছাত্রলীগের শুধু সাধারণ সম্পাদক প্যানেল গত এক বছরে ৫ লাখ টাকা বাকি খেয়ে টাকা পরিশোধ করেনি। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্যানেলের নেতা মেহেদী একাই ১ লাখ টাকার বেশি বাকি খেয়ে টাকা দেননি। তার অনুসারীদের খাবার খেতে পাঠিয়ে দিয়ে ফোন করে বলে দিতেন এবং পরে বিল চাইলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেন। ব্যবসা করতে দেবেন না বলে হুমকি দিতেন। এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদক প্যানেলের আরেক নেতা মিরাজ ৫০ হাজার টাকা বাকি খেয়েছেন।
লাল মিয়া বলেন, তারা প্রতিদিন একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০ জন করে এসে ইচ্ছামতো খেয়ে বিল না দিয়ে চলে যেতেন। তাদের থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বোঝার পর থেকে আমরা তাদের বাকি খাতায় তুলে রাখা থেকে বিরত থাকি।
এ বিষয়ে জবি ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালক মাসুদ রানা বলেন, দীর্ঘদিন বাকি খেয়েছে ছাত্রলীগ। টাকা দেবে দেবে করে আর দেয়নি। এর বাইরে আরও অনেকে আছে যারা টুকটাক খেয়েছেন, তার হিসাব নেই। খেয়ে তারা টাকা দিতেন না, আবার খাবার দিতে দেরি হলে ক্যান্টিনের কর্মচারীদের মারধরও করেছেন সাজবুলসহ বেশ কয়েকজন।
অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সবাই পলাতক থাকায় এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক ড. কে এ এম রিফাত হাসান বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। তবে বিষয়টি সত্য হলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নিয়মিত ছাত্র হলে তাদের থেকে টাকা আদায় করার ব্যবস্থা করা হবে এবং প্রশাসনিকভাবে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।